কেননা, ছেলেটা এমনিই তো মারা যাবে।
ছেলেটা! কে বলল?
আমি জানি। তারপর?
আটঘণ্টা ধরে করলাম।
সাকসেসফুল?
নিশ্চয়। এখন আবার সে নেটে প্র্যাকটিস শুরু করেছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, সে কাছে এসে বলল…
জানি। সে বলল অমল তোমার জন্য আমিও স্বপ্ন দেখব। তোমার পোলিও সেরে গেছে, তুমি ছুটছ, ভীষণ জোরে ছুটছ, সবাইকে হারিয়ে দিচ্ছ, ট্রফি জিতছ। তোমার জন্য ওলিম্পিকে ভারতের পতাকা উঠছে, জনগণমন সুর বাজছে।
নীলচে আকাশে যেন সোনালি রোদের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। গভীর ঝকঝকে চাহনি আনন্দর মুখের উপর বোলাতে বোলাতে অমল ঠোঁট টিপে মাথা নাড়তে লাগল।
না না না, তার থেকে বরং তুমি এক কাজ করো, রোজওয়ালকে উইম্বলডন জেতাও। মানোলিউ তবু যোলো বছর পর জিতেছিল, কিন্তু রোজওয়াল সেই কবে একুশ বছর আগে প্রথম উইম্বলডনে খেলেছে কিন্তু এবারও হেরে গেল। ভাবলে কষ্ট হয় না? বছরের পর বছর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু আর জিততে পারবে মনে হয় না, বয়স তো হয়েছে। চারবার ফাইনালে উঠে হেরেছে, বুড়ো হয়ে গেছে, আর কবে জিতবে বলতে পারো?
হালকা বিষগ্ন মেঘে অমলের চোখ ঢেকে গেল। আনন্দ ফিসফিস করে বলল, জিতবে। কোনর্সকেই হারাবে।
বলছ কী? সিক্স-ওয়ান, সিক্স-ওয়ান, সিক্স-ফোর, বিশ্রীভাবে কোনর্স এবার জিতেছে। ওকে হারানো রোজওয়ালের পক্ষে আর সম্ভব?
ইন্ডিয়ার আনন্দ ওকে হারাবে। তারপরই নিজেকে শুধরে বলল, আনন্দ মানে কিন্তু অমৃতরাজ নয়।
জানি। এ আনন্দ আমাদের।
পিছনে শব্দ হতেই আনন্দ ফিরে তাকাল। বিপিনদা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে।
দুপুরে তোমার ঘুমোবার কথা, আর তুমি গপ্পো করে যাচ্ছ? ডাক্তারবাবু কী বলে গেলেন সেদিন মনে নেই? কার সঙ্গে গপ্পো করছিলে?
আনন্দ জানলার দিকে তাকাল। অমল নেই।
কার সঙ্গে আবার গল্প করব। টেপ রেকর্ডার চালাচ্ছিলাম তো। শুনবে?
আনন্দ বোতাম টিপল টেপ উলটোদিকে গোটাবার জন্য। থামিয়ে এবার প্লে বোতাম টিপল।
উকিলবাবু, আপনার কাছেই আছে হীরা দত্তর দানপত্রটা। আপনি সেক্রেটারি, আপনার উচিত নয় কি ইনস্টিটিউটের স্বার্থ দেখা?
আনন্দ তাকাল বিপিনদার দিকে। ডগুদার সঙ্গে অনাদিপ্রসাদের কথার টেপ। চেম্বার থেকে ডগুদার গলার শব্দ পেয়েই রেকর্ডার চালিয়ে দিয়ে ঘরের ভিতরের জানলাটার উপর রেখেছিল। বিপিনদা অবাক হয়ে শুনছে।
দানপত্র আমার কাছে আছে, কে বলল? তাছাড়া জমিটা দানই করে দিয়েছে, এটাই বা তোমার মাথায় এল কী করে? ওটায় খেলতে দিয়েছিল শিবার বাবা, দান করে দেয়নি।
বাজে কথা, আপনি ওর উকিল, ওর কাছ থেকে টাকা পান, তাই শিবা দত্তর হয়ে বলছেন।
ডগু, ভদ্রভাবে কথা বলো।
আমরা সবাই জানি, এ জমির মালিক ইনস্টিটিউট। কারখানার সুবিধে হয় বলে জমিটা গাপ করতে চাইছে। আপনি তাকে সাহায্য করছেন।
তুমি বেরিয়ে যাও, নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেব, আর মাঠে যদি ওইরকম অসভ্যর মতো পোশাক পরা মেয়েছেলে দেখি, তোমাকে
কী আমাকে? মারবেন! কাটবেন?
যাতে ভালমতো শিক্ষা পাও, সেই ব্যবস্থাই করব।
আনন্দ বন্ধ করে দিল রেকর্ডার।
কারোর সঙ্গে গল্প করিনি, এবার বুঝলে?
সেইদিন রাতে ডগুবাবু যে ঝামেলা করে গেল, সেই সব কথা! কী আশ্চর্য, অদ্ভুত যন্তোর বার করেছে তো!
তোমার কথাবার্তাও এবার যন্তোরে ধরে রাখব যখন হাবুর মার সঙ্গে ঝগড়া করবে।
ভয় দেখাচ্ছ?
আনন্দ জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শুল। অমলের সঙ্গে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে খেলাচ্ছলে বোতাম টিপে টিপে রেকর্ড করেছে। রেকর্ডার চালিয়ে তাদের দুজনের সেই কথাগুলো শুনতে শুনতে সে জানলার বাইরে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। একসময় তার কানে এল অমলের গলা।
ভাবো তুমি জীবনের শেষ সুযোগের সামনে দাঁড়িয়েছ। সারা জীবন ধরে যে স্বপ্ন দেখেছ—
আনন্দ বন্ধ করে দিল। মনে মনে বলল:
কোনওদিনই শেষ সুযোগের সামনে আমার দাঁড়ানো হবে না।… কিন্তু ইচ্ছা থাকলে মানুষ কী না পারে। সে এই পৃথিবীর মধ্যেই আর একটা পৃথিবী বানিয়ে সেখানে জিততে পারে হারতেও পারে।
.
০৭.
প্লে।
প্রায় পনেরো হাজার লোেক মুহুর্তে কথা বন্ধ করল। নিশ্বাস নেওয়া ও ছাড়া হচ্ছে চুপিচুপি। উইম্বলডন সেন্টার কোর্টে সেমিফাইনাল ম্যাচ—কোর্নসের সঙ্গে ব্যানার্জির।
আনন্দর সার্ভিস।
শান্ত চাহনিতে দেখে নিল, বেসলাইনের মাঝামাঝি কুঁজো হয়ে শিকারি চিতাবাঘের মতো জিমি। সার্ভিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ডাইনে বাঁয়ে দুলছে। বাঁ হাতে ধরা র্যাকেট তীক্ষ্ণ নখের মতো। এখনও কানে বাজছে জিমির কথাগুলো। ছোট্ট ড্রেসিংরুমে তারা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আয়নায় চুল আঁচড়াচ্ছে। জিমি তার লম্বা চুলগুলো সমান ভাবে কান ঢেকে দুপাশ দিয়ে নামিয়ে দিতে দিতে মহম্মদ আলির ঢঙে বলেছিল: আই অ্যাম দ্য চ্যাম্পিয়ন—জাস্ট ট্রাই অ্যান্ড টেক মাই টাইটল অ্যাওয়ে।
ঘাসের ওপর বল ড্রপ দিল আনন্দ। সার্ভিসের আগে তিনবার বল ড্রপ দেওয়াটা তার অভ্যাস। জিমি সেমি ফাইনাল পর্যন্ত সেট হারায়নি এখনও। কোয়ার্টার ফাইনালে দেখেছে ট্যানারের ঘণ্টায় একশো চল্লিশ মাইলের সারভূকে জিমি কী অবহেলায় তাচ্ছিল্যে পালটা মার দিয়ে খুন করেছে। যত জোরে সারভূ আসে ততই যেন জিমির সুবিধে হয়।
আনন্দ আপন মনে হাসল। জিম্বাে, তোমার নাকি ছোটাছুটির স্পিড অকল্পনীয়, তোমার রিফ্লেক্স নাকি তুলনাহীন। দেখা যাক।