অদ্ভুত তো!
কেন? এই কি পৃথিবীতে প্রথম নাকি! মা প্রথমে রাজি হয়নি, বলেছিল এই বয়সে এসব করে তার কিছু হবে না। আমি বলেছিলুম হবে, আগে তো দৌড়ঝাঁপ করতে, আবার তুমি শুরু করো। তারপর শুনিয়েছিলাম রোমানিয়ার লিয়া মানোলিউয়ের কথা। মেকসিকো ওলিম্পিকে মেয়েদের ডিসকাস-এ সোনা জিতেছিল।
তুমি অনেক পড়েছ, অনেক খবর রাখো।
সামান্য সামান্য। কাগজে যা বেরোয় তাই একটু আধটু জানি। তা মানোলিউয়ের কথাটা শোনো, খুব ইন্টারেস্টিং। ওকে ট্রেনিং ক্যাম্পে আসতেই বারণ করেছিল ওদের ফেডারেশন, বয়স হয়ে যাওয়ার জন্য। বলেছিল, তোমার দ্বারা আর কিছু হওয়া সম্ভব নয়, সুতরাং মিছিমিছি কেন আর ট্রেনিংয়ে আসা। এর ন মাস পরেই সে সোনা জেতে মেকসিকোয়। তখন বয়স কত জান? সাঁইত্রিশ! আমার মা-র বয়সও। তাই। মাকে তো আর ওলিম্পিকে সোনা জিততে হবে না, পেতে হবে একটা চাকরি। ঘরের মধ্যে রাতের পর রাত মানোলিউ ওজন তুলেছে, তিন ঘণ্টা করে। সবাইকে ভুল প্রতিপন্ন করবেই করবে। ইচ্ছা থাকলে মানুষ কী না পারে? স্বামী, সন্তান সব ঘুমোচ্ছে, আর সে একা ট্রেনিং করে গেছে, সঙ্গী শুধু রেডিয়োটা, আর বিড়বিড় করে কবিতা আবৃত্তি করেছে যাতে শরীরের কষ্ট ভুলে থাকতে পারে। দৃশ্যটা ভাবতে পারো আনন্দ? কী ভয়ঙ্কর কষ্ট স্বীকার করে সোনা পেয়েছে! কী তেজ, কী রোখ।
তুমি ভাবতে পারো এমন দৃশ্য?
একটুও ইতস্তত না করে অমল বলল, পারি। মানুষ যখন বার বার হেরে যায় তখন হাল ছেড়ে ভেঙে পড়ে। কিন্তু অনেকে পড়ে না। তারাই শেষ পর্যন্ত জেতে। মানোলিউ হেলসিঙ্কি থেকেই ওলিম্পিকে নামছে। সেখানে সিকসথ, মেলবোর্নে নাইনথ, রোমে ব্রোঞ্জ, টোকিয়োতে ব্রোঞ্জ। চারবার চেষ্টা করছে, সোনা পায়নি, তবু সে ভেঙে পড়েনি। যোলো বছর পর মেকসিকোয় যখন ফাইনালে ছুড়তে এল, তখন ডান হাতে চোট। ডাক্তার ইনজেকশান দিয়ে বলেছে, একবার ছোড়ার পরই কিন্তু হাতের জোর কমে যাবে। শুধু একবারই জোরে ছুড়তে পারবে।
অমলের চোখদুটো স্থিরভাবে তাকিয়ে রয়েছে। আনন্দ বিছানায় উঠে বসল। চোখদুটো তাকে যেন চুম্বকের মতো টেনে নিচ্ছে।
জিতল তো?
নিশ্চয়, প্রথমবারেই যা ছুড়েছিল তাতেই। কিন্তু তখন তার মনের অবস্থাটা কল্পনা করতে পার?
আমি কখনও এরকম অবস্থায় পড়িনি।
কল্পনা করো, একটা এইরকম অবস্থা তৈরি করো মনে মনে। ভাবো, তুমি জীবনের শেষ সুযোগের সামনে দাঁড়িয়েছ। সারা জীবন ধরে যে স্বপ্ন দেখেছ তা পূর্ণ হবে কি হবে না, সেটা তুমিই এই মুহূর্তে একমাত্র জানো। এইটাই শেষ, আর সুযোগ কখনও আসবে না তোমার কাছে। কল্পনা করো।
তুমি করতে পারো?
অমল মাথা হেলাল।
আমি ওলিম্পিকে একশো, দুশো, চারশো মিটারের সোনা জিতি।
আনন্দ হেসে ফেলল।
দেবুদা যেমন দারুণ জটিল খুনের মামলার আসামিকে নির্দোষ প্রমাণ করে জেতার স্বপ্ন দেখে।
হ্যাঁ। সবাই স্বপ্ন দেখে, ঘুমিয়ে নয় জেগে। আমার মতো সব মানুষের ভিতরেই কোনও না কোনও অঙ্গ পোলিয়োয় পঙ্গু হয়ে আছে মনে হয়। তাই আস্ত গোটা হবার জন্য স্বপ্ন দ্যাখে।
যাঃ কী বাজে কথা বলছ।
আমার যা মনে হয় তাই বললুম। সব মানুষই জিততে চায় কিন্তু পারে না এই পোলিয়য়ার জন্য। তুমি নিখুঁত মানুষ দেখেছ?
আনন্দ একটু ভেবে মাথা নাড়ল।
নিখুঁত হওয়া আর জেতা একই ব্যাপার। আসলে সবাই নিখুঁত হতে চায়।
তা হলে স্বপ্ন দেখে কী হবে?
ওইভাবেই ইচ্ছাটা পূরণ করে। স্বপ্নে তুমি যা খুশি হতে পারো। স্বপ্ন দেখে তারাই যাদের মন আছে, ইচ্ছে আছে। দুর্বল লোকে স্বপ্ন দেখতে পারে না, আমার অনেক ইচ্ছে আছে, জানি সেগুলো পূরণ হওয়া সম্ভব নয় তাই স্বপ্নে পূরণ করি, সেখানে আর একটা পৃথিবী আর এক অমল, সে সব জেতে—সব সব। ইচ্ছে করলে হারতেও পারি, এত ক্ষমতা আমার। নিজেকে বিরাট মনে হয় সেই পৃথিবীতে, তাই সারাক্ষণ সেখানেই থাকি।
সারাক্ষণ স্বপ্ন দেখো!
চমৎকার সময় কাটে। একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাকেও আমি দৌড়ে হারাতে পারব না। কিন্তু আমি সাড়ে ন সেকেন্ডে ওয়ার্লড রেকর্ড করে বোরজভকে হারিয়েছি মিউনিখে। বিকিলাকে হারিয়েছি ম্যারাথনে।
আকিবুয়াকে?
চেষ্টা করিনি।
মার্ক স্পিজকে?
সাঁতার ভাল লাগে না।
কী ভাল লাগে তোমার?
অমল কাঁধে গাল ঘষল। ওর চোখে আর চুম্বক নেই। একপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কষ্টটা চোখে ধরা পড়ছে। আনন্দ ভাবল ওকে বলে ভিতরে এসে বিছানায় তুমি শশাও। কিন্তু ও আসবে না। প্রথমদিন ভিতরে আসতে বলেছিল, তখনও বলে ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ থাকলেই নাকি ওর মাথার মধ্যে কেমন করে। সব কিছু মনে হয় তার পায়ের মতো সরু দোমড়ানো এমন কী মানুষের মুখ চোখও ভাঙাচোরা বাঁকানো মনে হয়। তাই বাড়ির বাইরেই সারাক্ষণ কাটায়। আনন্দর কাছে এটা অদ্ভুত লেগেছিল। সে চেষ্টা করেও মানুষকে সরু যা দোমড়ানো চেহারা করতে পারে না। এজন্য মনের মধ্যে তা হলে দয়ানিধির দোকানের অদ্ভুত আয়নাটার মতো একটা আয়না দরকার যেখানে তাকালেই মুখটা লম্বা চ্যাপ্টা তোবড়ানো দেখাবে।
কাল রাতে আমি ডাক্তার হয়েছিলাম। বিরাট কেউ নয় খুব অখ্যাত সার্জন। কেউ সাহস পাচ্ছে না…একটা হার্টবদল করার অপারেশন, পি জি হাসপাতালে। আমি গিয়ে বললাম, আমি করে দেব। ওরা বিশ্বাসই করতে চাইছিল না। যাই হোক শেষকালে রাজি হল, কেননা…