আবার গোলাটা পড়ল। ইটে সাজানো সার্কলের কিনারে দেহের টলমলে ভারসাম্য সোজা করে রাখতে রাখতে গীতা তীক্ষ্ণচোখে তাকাল যেখানে গোলাটা পড়েছে। আনন্দ হাত তুলে ওকে অপেক্ষা করতে ইঙ্গিত করল।
এগিয়ে এসে গোলাটা তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দর মনে হল, এখান থেকে সার্কলটা মাত্র পনেরো-ষােলো হাত তত দূরত্ব! বোলার অ্যান্ডি কি হাতে করে পৌঁছে দিয়ে আসবে? একজন মেয়ে যদি ছুড়তে পারে এতটা তাহলে আমিই বা পারব না কেন, অমল কি সবাই? ভারী জিনিস তোলা বারণ, কিন্তু একবার তুললে এমন কী আর হবে! কিছু হয় কি না দেখাই যাক না।
ডান গালের কাছে গোলাটা ধরে আনন্দ ঠিক গীতার নকল করে কুঁজো হল। কনুইয়ে যন্ত্রণা, কবজি বেঁকে যাচ্ছে। গীতার মুখে হাসি খেলে গেল, তাই দেখে আনন্দর মুখেও হাসি ফুটল, শরীরে কী রকম একটা রোখ ঝাঁঝিয়ে উঠল। শরীরটা দোলাতে দোলাতে হাঁ করে নিশ্বাস নিয়ে ডান পায়ে ভর দিয়ে গীতার মতো ছোট ছোট দ্রুত লাফে গোলাটা ছোঁড়ার জন্য একধাপ লাফিয়েই হঠাৎ তার মনে হল সে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চাপা চিৎকার করে সে পড়ে গেল মাটিতে। গোলাটা পড়ল তার ডান পায়ের পাতা ঘেঁষে।
যখন সংবিৎ ফিরল, আনন্দর মনে হল, সে যেন ঢেউয়ের উপর ভাসছে। চোখ খুলেই লজ্জায় চোখ বন্ধ করল। লেডি সোবার্স তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে। পাশে হাঁটছে অমল!
আমায় নামিয়ে দিন, এভাবে আমায় নিয়ে যাবেন না বাড়িতে।
আনন্দর করুণ ক্ষীণ স্বর অগ্রাহ্য করেই ওরা ফটকের কাছে পৌঁছল।
আর যাবেন না, নামিয়ে দিন এখানে।
ওকে নামিয়ে দিল গীতা। এইরকম পোশাকে অচেনা বাড়িতে যেতে তারও সঙ্কোচবোধ হচ্ছে।
পারবে হেঁটে যেতে? আর কখনও কিন্তু এমন কাণ্ড করবে না, অল্পের জন্য পা-টা বেঁচে গেছে। অমল, তুই ওকে ভিতরে পৌঁছে দিয়ে আয়। গা-টা বেশ গরম লাগছিল। বোধহয় জ্বর হয়েছে।
গীতা তালুটা আনন্দর কপালে রাখল। তাড়াতাড়ি আনন্দ ফটক পেরিয়ে বাড়ির দিকে এগোল। হাঁটু কাঁপছে, হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়ল সে।
তুমি আমার কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে চলো। মা জানে না তোমার হার্টের অসুখ।
পিছন থেকে এগিয়ে এল অমল। আনন্দর ডান হাতটা ধরে নিজের কাঁধে রেখে বলল, চলো।
আনন্দ ভয় পেল। অবশেষে এক বিকলাঙ্গের উপর ভর করতে হচ্ছে! অসম্ভব একটা রাগে ঝাঁঝরা হতে হতে অমলের কাঁধে চাপ দিয়ে বলল, আমার মরে যাওয়া উচিত, যাবও।
কেন?
আনন্দ জবাব দিল না?
রাগ করছ কেন? মানুষ মানুষের সাহায্য কি নেয় না বিপদে পড়লে? এতে লজ্জার কী আছে?
সে তুমি বুঝবে না।
অমল হাসল। হাসিটা স্লান দুঃখভরা। আনন্দ ইতস্তত করে বলল, তোমাকে সাহায্য নিয়ে চলতে হয়
নিশ্চয়। তাই তো আমি ভাল করে জানি মানুষের কাছে মানুষ কত দরকারি।
কিন্তু আমারও মানুষকে দরকার। একা একা হাঁপিয়ে গেছি।
ঠিক আছে, মাঝে মাঝে আসব।
বিপিনদার গলার শব্দ এগিয়ে আসছে। আনন্দ ভিতরে ঢুকে গেল।
.
আজ কেমন আছ?
আনন্দ বিছানার উপর গড়িয়ে জানলার ধারে সরে এসে মাথা হেলিয়ে হাসল, ভাল।
উত্তরের জানলার শিক ধরে অমল কনুই দুটো জানলার পাটায় রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল।
কী করছিলে?
আনন্দ টেপরেকর্ডারটা দেখাল।
ভীষণ মজার জিনিস। কাল বিকেলে ডগুদার মাঠের ঝগড়ার ঘর থেকে যা শুনতে পাচ্ছিলাম, টেপ করেছি।
আনন্দ প্লে লেখা বোতামটা টিপল। প্রথমে খরখর শব্দ হয়ে দূরে মোটরগাড়ি চলার, উঠোনে বাসনের, দোতলায় বিপিনদার গলার, ট্রেনের ভেঁপুর আওয়াজের মধ্য দিয়ে প্রকট হতে লাগল ডগুদার সঙ্গে কারখানার ম্যানেজারের ঝগড়া।
আমি বলছি সরাতে হবে…জানতেই পারবেন কে আমি।… আমি একজন পাবলিক, আমার বলার অধিকার আছে।
যান যান মশাই, পারেন তো কোর্টে গিয়ে প্রমাণ করুন যে এ-জমি ইনস্টিটিউটের।
কোর্ট ফোর্ট কী দেখাচ্ছেন, রীতিমতো লেখাপড়া করে দান করা জমি। সবাই জানে…
দলিল আছে?
আলবাত আছে। সেক্রেটারি অনাদিবাবুর কাছে আছে।
মালিককে গিয়ে ওসব কথা…
সে ব্যাটার দেখা পেলে তো…
মুখ সামলে…লরি রোজ দাঁড়াবে…অ্যাই দরোয়ান, ড্রাইভারকে বলবে এখানে…
তুলে দোব কারখানা, আগুন জ্বালিয়ে দোব। এটা খেলার মাঠ, শিবা দত্তর কারখানার জমি নয়। দরকার হলে কোর্টেই যাব। অ্যাজিটেশন করব, আন্দোলন হবে।
আনন্দ বোতাম টিপে বন্ধ করে দিল।
ডগুদার ফেভারিট হবি আন্দোলন করা। দুজনেই হাসল।
প্রত্যেক মানুষেরই একটা না একটা হবি থাকেই। দেবুদার হল ডিটেকটিভ মেইগ্রে। তোমার কোনও হবি আছে?
না।
অমল মুখ ফিরিয়ে রাখল অন্যমনস্কের মতো। আনন্দ মুখ নামিয়ে টেপরেকর্ডারে হাত বুলোতে লাগল।
মা আর প্র্যাকটিস করতে আসবে না। এখানকার অনেকেই পছন্দ করছে না ওর। হাফপ্যান্ট
আমার বাবা?
তাছাড়া কারখানার তিন-চারটে লোক রাস্তায় কাল টিপ্পনী কেটেছিল। বোধহয় ম্যানেজার কি মালিক পিছনে লাগতে বলে দিয়েছে। মা একজনকে চড় কষায়, আর একজনের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। ওরা শাসিয়েছে।
ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
হ্যাঁ। পারবে না কেন, মা-তো রোজ রাত্রে ঘরে ওয়েট-ট্রেনিং করে। ওজন তোলে, ওজন টানে, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর।
ওজন?
লোহা। ইনস্টিটিউটে বারবেল, ডাম্বেল, পুলি পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল। ডগুদা সেগুলো দিয়েছে। দিনের বেলায় কাজকর্ম ফেলে একসারসাইজ করতে দেখলে বাড়িতে রাগারাগি করবে তাই রাতে করে।