আনন্দ?
কোচ অস্ফুটে কী বলে মাথা হেলালেন।
দেখছেন, বল করেই বুক চেপে ধরছে।
বোধহয় মাসলে টান ধরেছে।..ওয়েল অ্যান্ডি, স্টপ নাই।
কোচ হাত তুলে আনন্দকে নিষেধ করলেন। রেস্ট নাও, মাসাজ করো আস্তে আস্তে।
আনন্দ হাঁপ ছেড়ে কৃতজ্ঞ এবং বাধ্য ভঙ্গিতে বোলারদের দল থেকে সরে দাঁড়াল।
পড়াশুনোয় মোটামুটি তবে ইম্যাজিনেটিভ রচনা লিখতে পারে। ওর দাদাও যেন। কোন এক ক্লাবে খেলে, শুনেছি।
কী নাম?
নাম টাম তেমন নেই।
অ।
বিনয়বাবু অটিকে গ্রাহ্য না করে বলে চললেন, গুড বনেদি ফ্যামিলি, সবাই শিক্ষিত। দুই দাদা, বড়টি কানাডায় আছে আট বছর, ডাক্তার। অন্যটি মার্কেন্টাইল ফার্মে জুনিয়ার অফিসার আর ক্রিকেটও খেলে। বাবা উকিল, ভাল প্র্যাকটিস। তিনজনের ছোট্ট ফ্যামিলি।
তিনজন কেন, মা?
নেই। ওর ছোটবেলাতেই মারা গেছেন।
পুওর বয়।
কোচ মুখ ফিরিয়ে আনন্দকে দেখতে চাইলেন। আনন্দ নেই। প্রায় একশো বিঘের বিরাট নেতাজি পার্কের উপর দিয়ে চোখ বোলালেন। এক প্রান্তে টেনিস ক্লাব। লোহার উঁচু জালে এবং পর্দায় ঘেরা দুটি হার্ড কোর্ট ও একটি গ্রাস কোর্ট, সঙ্গে তাঁবু। তার পাশে একটি পুকুর। চিলড্রেনস পার্ক। অন্যদিকে ফুটবল মাঠ। ক্রিকেট ম্যাচও এখানে হয়। তিন-চারটি টালির চালাঘর পার্কের গেটের পাশে। কোনওটি ক্লাবঘর, কোনওটি ব্যায়ামের আখড়া। গেটের সামনেই নেতাজির ব্রোঞ্জ মূর্তি।
কোচ খুঁজে পেলেন না আনন্দকে।
গেল কোথায় ছেলেটা? বাড়ি কি কাছাকাছি?
অন্তত দু কিলোমিটার। বিনয়বাবুও পার্কের প্রান্তগুলিতে চোখ পাঠাচ্ছেন। এখন সব স্কুলেই গ্রীষ্মের ছুটি। সময়টা দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। গুটি তিরিশ ছেলে এবং কয়েকটি ফুটবল মাঠে নেমে পড়েছে। পুকুরেও ঝাঁপাঝাঁপি শুরু হয়ে গেছে। আনন্দকে তিনিও দেখতে পেলেন না।
আনন্দ ফাস্ট বোলার হবার মতো মেটিরিয়াল। এই বয়সেই এত পেস, এত কন্ট্রোল, ভাবাই যায় না।
দারুণ ব্যাটও করে। এবারই ইডেনে সামার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চল্লিশ বলে। সেঞ্চুরি করেছে। ভীষণ পিটিয়ে খেলে।
কোচ ঘাড় নাড়লেন। অর্থাৎ খবরটা জানেন। এরপর চেঁচিয়ে উঠলেন, আহ সোবার্স, তুমিও গাভাসকারের মতো ভুল করছ… ফরোয়ার্ড খেলার বল বেছে নাও, সব বলেই কি খেলে? কোন বল ছাড়বে সেটা বিচার করা অনেক শক্ত ব্যাপার। তা ছাড়া শরীর আর ব্যাটের মধ্যে অত ফাঁক থাকছে কেন?
বিনয়বাবু সেই ফাঁকে একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে, আনন্দ কোথায় গেছে রে?
বোধহয় টেনিস দেখছে। কাল তো ফেরার সময় ওখানেই ঢুকে পড়েছিল। আমাদের সঙ্গে আর ফেরেনি।
.
সুরকির দুটি হার্ডকোর্ট তার পাশে আর একটি ঘাসের। আটটি ছেলে ও দুটি মেয়ে। কেউ ফোরহ্যান্ডে কেউ ব্যাকহ্যান্ডে ক্রমান্বয়ে বল মেরে যাচ্ছে বেসলাইন থেকে। নাগাড়ে সার্ভিস করে চলেছে দুজন পাশের কোর্টে। বছর দশেকের দুটি ছেলে ঠোঁট কামড়ে নেটের এপার-ওপার করাচ্ছে বলটিকে অসম্ভব মনোেযোগে। সাইডলাইনের ধারে কোচ দাঁড়িয়ে।
আনন্দ ইতস্তত করে, তারপর কোর্টের একটু দূরে নীলপর্দা ঘেঁষে পাতা তিনটি বেঞ্চের একটিতে গিয়ে বসে। কেউ কিছু বলল না, তাকালও না। সে নিজের ক্রিকেট বুট ও সাদা ট্রাউজার্সটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করল। তার মতো এরাও প্লেয়ার, সুতরাং, আনন্দ ভাবল, প্লেয়ার হিসাবে এরা আর এক প্লেয়ারকে নিশ্চয়ই বেরিয়ে যেতে বলবে না। খুব ছোট থেকেই সে নেতাজি পার্কে আসছে। তখন আসত মেজদার সঙ্গে। মেজদা ক্রিকেট খেলত মিলন পল্লিতে। আনন্দ ক্রিকেট ফেলে টেনিস কোর্টের পাশে গিয়ে দাঁড়াত। টেনিস কেন যে তাকে টানে সে জানে না, বুঝতেও পারে না। হয়তো একা একা খেলতে হয়, লড়তে হয়, একাই জিততে হয়। ক্রিকেটও তাই। ব্যাটসম্যানকে একাই ব্যাট করতে হয়, ফিল্ডারকে একাই ক্যাচ লুফতে হয়। বোলারকে শুধু অন্যের সাহায্য নিতে হয় কখনও কখনও। এটা তার কাছে। অপমানকর মনে হয়। তাই সে চেষ্টা করে প্রতি বলে বোল্ড আউট করতে। ভিড়ের থেকে নির্জনতা তার ভাল লাগে, অন্যের সাহায্য নেওয়ার থেকে নিজের চেষ্টায় কাজ করা, দল বেঁধে চিৎকার করে খেলার থেকে মুখবুজে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ায় তার আনন্দ বেশি।
টেনিস কোর্টের ছোট্ট একটা জায়গার মধ্যে বাঘের মতো কখনও ওত পেতে থাকা, কখনও থাবা মারা, কখনও ঝাঁপিয়ে পড়া। একই সঙ্গে স্লিপ ফিল্ডিং, ব্যাটিং আর ফাস্ট বোলিং! আনন্দ একদৃষ্টে লক্ষ করে সার্ভিসে ব্যস্ত দুজনের দিকে। হুবহু ফাস্ট বোলিং। ছুটে এসে বাঁ কাঁধ ব্যাটসম্যানের দিকে হতে হতে জমি থেকে শরীরটাকে একটু উঠিয়ে নিয়ে ডান পায়ের ভরে একটু পিছনে হেলে…তারপরই সার্ভিস আর বোলিং একই ব্যাপার। বাঁ হাত থেকে উঁচুতে ছুড়ে দেওয়া বলটা নামছে, ডান হাতের র্যাকেট আর ছিলে হেঁড়া ধনুকের মতো শরীরটা একই সঙ্গে সামনের দিকে ছিটকে যাচ্ছে বাঁ পায়ে ভর রেখে।
চশমাপরা ছেলেটির সার্ভিসে জোর নেই। লক্ষ করতে করতে আনন্দর মনে হল, এই ভুলটা তারও হত এবং অনেকটা কমাতে পেরেছে গত চার-পাঁচ দিনে। বল ছাড়ার সময় তার শরীরের ওজন বলের সঙ্গে না দিয়ে, পিছনে হেলিয়ে রাখত। এই ছেলেটিও বলে র্যাকেটের ঘা দেবার সময় পিছনে শরীরটা হেলিয়ে রাখছে। খুবই সাধারণ ভুল। এই ভুলটার কথা, তার ইচ্ছা করতে লাগল, ছেলেটিকে জানিয়ে দিতে।