১. হোয়াটস দ্য ম্যাটার
০১.
হ্যাল…লো অ্যান্ডি রবার্টস, হোয়াটস দ্য ম্যাটার উইথ য়্যু! দাঁড়িয়ে কেন? যাও যাও বল করো।
বলতে বলতেই প্রৌঢ় কোচ নেটের দিকে তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, পিচের কাছে পা, বলের পিচের কাছে পা এনে ফরোয়ার্ড। মুখ উঠছে। কেন? নির্ভয়ে খেলো। ইয়েস অ্যান্ডি—।
নিচু হয়ে গড়িয়ে আসা বলটা তুলে নিয়ে কোচ ছেলেটির দিকে ছুড়ে দিলেন।
মাত্র দু ওভার করেই কোমরে হাত! ব্র্যাডম্যান টানা কুড়ি ওভার বল করিয়েছিল মিলারকে দিয়ে ফরটি এইট নটিংহাম টেস্টে। সেকেন্ড ইনিংসে টোটাল চুয়াল্লিশ ওভার বল করেছিল মিলার। আর তুমি…কী করে খেলবে এই স্ট্যামিনা নিয়ে? প্র্যাকটিস প্র্যাকটিস, যে ভুলগুলো দেখিয়ে দিলাম শুধরে নাও। যাও যাও।
কোচ এগিয়ে এলেন নেটের ধার ঘেঁষে ব্যাটসম্যানের দিকে।
কলকাতার পুব শহরতলির নেতাজি পার্কে প্রায় পঁচিশটি ছেলেকে নিয়ে সাতদিন হল চলছে এই ক্রিকেট কোচিং। ব্যবস্থা করেছে পার্কেরই নেতাজি ব্যায়ামগার সি এ বি-র সহযোগিতায়। ছেলেদের বয়স চোদ্দো থেকে কুড়ির মধ্যে। অধিকাংশই স্কুল ছাত্র। কোচ করছেন যিনি, একদা রঞ্জি ট্রফিতে ছটি ম্যাচ খেলেছেন। প্রচুর বই পড়ে তিনি খেলা শিখেছেন কিন্তু একবার ৩৯ ছাড়া কখনও দশের বেশি রান করেননি।
আন্দ, দাঁড়িয়ে থাকিনি, কোচ তোর দিকে তাকাচ্ছে।
পাশ দিয়ে যাবার সময় ফিসফিসিয়ে বলে গেল আর একটি ছেলে।
আনন্দ মুখ তুলতেই কোচের সঙ্গে চোখাচোখি হল। বল হাতে সে মন্থরগতিতে বোলিং মার্কের দিকে এগোল। সতেরো কদম দূরত্ব থেকে ছুটে এসে বল করে সে। দূরত্বটা এখন তার কাছে সতেরো মাইল মনে হচ্ছে। কাউকে সে বলতে পারছে না আজ সকাল থেকে গা গরম, হাতে পায়ে গাঁটে গাঁটে ব্যথা, একটু ছুটলেই হাঁফ ধরছে। বল করার পরই বুকে ব্যথা উঠছে। এসব কথা কাউকে বলাটা তার কাছে লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু সে বুঝতে পারছে আর এখন বল করতে পারবে না। করলে বুকের যন্ত্রণাটা বাড়বে।
ডেলিভারিটা সে একটু আস্তেই করল। ইনসুইং গ্রিপে বলটা ধরেছিল। অফ স্ট্যাম্পের ইঞ্চি চারেক বাইরে জমিতে পড়ে ছিটকে এসে অফ স্টাম্পে লাগল। পা দুটো নাড়াতে পারেনি, শুধু কুঁজো হয়ে ব্যাটটা এগিয়ে ধরে ব্যাটসম্যান বোকার মতো হেসে চোখের দিকে তাকাল। কোচ হাসিমুখে মাথা নাড়ছে। আনন্দ ভাবেনি বলটা অতখানি ছিটকে ঢুকে যাবে। কী করে এটা হল? ভাবতে ভাবতে ঘাড় ফিরিয়ে শুয়ে পড়া অফ স্টাম্পের দিকে তাকিয়েই, বুকে হাত রাখল। আবার সেই শ্বাসকষ্ট।
সময় নেবার জন্য আনন্দ আরও মন্থর পায়ে বোলিং মার্কে ফিরে এল। তিনজন স্পিনার ও একজন পেসার বল করছে। তাদের বল হয়ে যাবার পরেও আনন্দ ইতস্তত করল। ইশারায় সে বল করে যেতে বলল তাদের। কোচ সেটা লক্ষ করে, এগিয়ে এল।
ব্যাপার কী?
কীরকম যেন হাঁপ ধরছে।
এই কটা বল করেই! দেখে তো তোমাকে দুর্বল মনে হয় না। …আইডিয়াল ফিগার ফর এ ফাস্ট বোলার, হাঁপ ধরলে তো চলবে না; রান-আপটা এখনও জার্কি রয়েছে, সুদ করতে হবে। তা ছাড়া ডেলিভারির সময় বাঁ কাঁধটা ব্যাটসম্যানের দিকে যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলাম, বাঁ-পায়ের উপর ভর দিয়ে পাছা থেকে শরীরের উপর দিকটা হাত থেকে বল ছাড়ার আগের মুহূর্তে যেভাবে ঘুরবে..হচ্ছে না তো। নিখুঁত হতে হলে অনবরত বল করে করে তৈরি হয়ে উঠতে হবে। আস্তে বল করো, এখনই গ্রেগ চ্যাপেলকে বল করতে হচ্ছে না তো…আস্তে দৌড়ে এসো, আস্তে ডেলিভারি দাও। বয়স কত?
ষোলো।
ক্লাস?
টেন।
ফেল করেছিলে কখনও?
না।
কোচ নেটের দিকে তাকিয়ে ঘড়ি দেখলেন। প্যাড পরে অপেক্ষমাণ শিবনাথকে আঙুল তুলে বললেন: ইউ সোবার্স, গো।তারপর চেঁচিয়ে—গাভাসকার লিভ দ্য নেট, ইওর টাইম ইজ আপ।
গোবিন্দপ্রসাদ বেরিয়ে এল নেট থেকে।
আরও দুটো বল করল আনন্দ। প্রতিটি ডেলিভারির পর শ্বাস নিতে গিয়ে তার মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে বাতাস ঢুকছে না। বুকটা খালি। হাঁটু, কনুই যন্ত্রণায় খুলে পড়বে যেন। কাল রাতে জ্বর হয়েছিল। আজও হয়তো হবে। সে ভাবল, আর বল করা উচিত নয়। চুপচাপ এক ফাঁকে কেটে পড়তে হবে নয়তো জোর করে বল করাবে। ব্যায়ামাগারের দেয়ালটা পাশেই, সেটা শেষ হয়েছে পলাশ গাছটার লাগোয়া। ওই পর্যন্ত গিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই কেউ দেখতে পাবে না। পার্কের পিচের রাস্তাটা ধরে টেনিস ক্লাবে ঢুকে বসে থাকলে কেউ এখন আর খুঁজে পাবে না তাকে। টেনিস তার ভাল লাগে। একসময় তার ইচ্ছা করত কৃষ্ণন হবে কিংবা রোজওয়াল। কিন্তু ক্রিকেটের টান সে আরও বেশি অনুভব করে টেনিসের থেকে।
কোচ বলল, ফললা থ্রু না করেই অমন দাঁড়িয়ে যাচ্ছ কেন?
আনন্দ বলতে পারল না কষ্ট হচ্ছে, সেটা আপনাকে আমি দেখাতে চাই না।
ধুতি-পাঞ্জাবি পরা গেমস টিচার বিনয়বাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন কোচের পাশে। তাঁর দিকে তাকিয়ে কোচ বললেন, পুরো ঝাঁকটার মধ্যে এই একটিই ছেলে…হবে, এরই হবে। ক্লাস আছে, রীতিমতো পেস আছে। কুইকলি ত্রুটিগুলো শুধরেও নিচ্ছে।
বিনয়বাবু খুবই বিজ্ঞােচিত ভঙ্গিতে বললেন, ইন্ডিয়ার তো এখন পেস বোলার দরকার।
কোচ অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। যেন, বেঁচে থাকার জন্য বাতাসের দরকার এই রকম একটা আবিষ্কারের কথা তাঁকে শোনানো হল। এখন দরকার, মানে! বরাবরই দরকার। নিসার-অমর সিং জুড়ির পর খাঁটি ওপেনিং অ্যাটাক কোনওদিনই আমাদের ছিল না, খাঁটি ফাস্ট বোলার নিসারের পর আজও হয়নি। বোধহয় এবার হবে।