ঝুপা পকেট থেকে একটু ভাঁজ করা ছুরি বার করে অচৈতন্য গুলাবির দিকে এগিয়ে যাওয়ামাত্রই তৃতীয়জন তাকে হাত বাড়িয়ে থামাল। বলল, আবার এইসব খুনখারাপি কেন? জায়গাটা গরম হয়ে যাবে যে।
তুমি থাম। ঝটকা মেরে তার হাতটা সরিয়ে দিল মধু। যত গরম হয় তত লাভ। ছ্যাঁকা। খেয়ে শালা প্রমিত ব্যানার্জি যাতে দৌড়ে পালাবার পথ না পায় সেই ব্যবস্থাই করছি। এই ঝুপা, মাগিটার হাত-মুখ বাঁধ। কী দিয়ে বাঁধবি আবার জিগ্যেস করছিস? শাড়িটা আছে কী করতে?
ইঙ্গিত বুঝতে ঝুপার অসুবিধে হল না। ততক্ষণে রাকেশ বলে সেই ছেলেটাও কথাবার্তার আওয়াজে ওপরে উঠে এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে দুজনে মিলে গুলাবির শরীর থেকে সমস্ত কাপড় ছিঁড়ে ওকে নগ্ন করে ফেলল। ধর্ষণের সময় গুলাবির জ্ঞান ফিরে এসেছিল, কিন্তু হাত-পা বাঁধা থাকায় তার কিছু করার ছিল না। চারটি পুরুষপুঙ্গব একে একে তার ওপরে অত্যাচার চালিয়ে শেষে অবিকল পাঁঠা জবাইয়ের ঢঙে তার গলার নলিটা কেটে দিয়ে নেমে গেল নীচে।
ওরা চলে যাওয়ার পরেও গুলাবির নিথর শরীরের আশে পাশে ডানা বাঁধা পায়রাটা লেঙচে লেঙচে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অন্ধকার আরও একটু গাঢ় হতেই একটা প্যাঁচা এসে সেটাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল।
.
০৭.
পরেরদিন প্রমিতের জিপসি যখন হরিণডুবি ফরেস্ট বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল, তখন ঘড়িতে বাজে ছটা। ভোরের লজ্জারুণ মুখে তখনও কুয়াশার হালকা ওড়না।
হরিণডুবি বাংলোটা জয়ন্তীর একেবারে তীর ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছিল। নদীর বুকেও। তখনো কুয়াশা জমাট বেঁধে রয়েছে।
বাংলোর সামনের দিকে, মানে নদীর দিকে মুখ করে চওড়া বারান্দা। সেখানে একটা টি-টেবলের দুপাশে দুটো বেতের চেয়ারে বসে চা পান করছিল দ্যুতি আর রূপেন শইকিয়া। গাড়ি থেকে নেমে কাঠের গেটটা খুলে প্রমিত নুড়িপাথরের রাস্তা ধরে সেই দিকে এগিয়ে গেল। প্রমিতকে দেখে রূপেন উঠে দাঁড়িয়ে সাদরে ডেকে নিল তাকে। দ্যুতি কি করবে ঠিক করে উঠতে না পেরেই যেন চশমাটাকে আঙুলের ঠেলায় চোখের ওপর তুলে দিল। প্রমিত একটা চেয়ারে। বসার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলোর বেয়ারা তার সামনে চায়ের পেয়ালা আর বিস্কিটের প্লেট রেখে গেল।
চায়ের কাপে একটা বড় চুমুক দিয়ে তৃপ্তির আওয়াজ করল প্রমিত। তারপর চেয়ারে গাটা এলিয়ে আরাম করে বসল। এই স্নিগ্ধ ভোর, এই কুয়াশায় ভেজা ঘাসপাতার তাজা গন্ধ আর অজস্র পাখির গান তার মনের ওপর গত পাঁচদিন ধরে জমে থাকা বিষণ্ণতার পরতটার ওপর ডাস্টার বোলাচ্ছিল। আস্তে আস্তে আগের মতন উজ্জ্বল আর আনন্দময় হয়ে উঠছিল তার অন্তরাত্মা।
প্রমিতের হাবভাব লক্ষ করে রূপেন শইকিয়া বললেন, আরেকটু পরেই বেরোই না কি মিস্টার ব্যানার্জি? এই কুয়াশায় রিভারবেড দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধে হবে। পাথরে লেগে মোবিল ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে যেতে পারে। মনে হয় আধঘন্টার মধ্যে রোদ উঠে যাবে, তখনই না হয় বেরোব আমরা। ততক্ষণে বরং আমরা ব্রেকফাস্টটা করে নিই। তাহলে ফিরবার তাড়া থাকে না।
প্রমিতের নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে রূপেন শইকিয়া ব্রেকফাস্টের কথা বলবার জন্যে বাংলোর পেছনে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রমিত তার বাঁ-পাশে বসে থাকা দ্যুতির দিকে ফিরে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, আপনার কাজের ব্যাপারে মিস্টার শইকিয়ার সাথে কথা হয়েছে?
হুঁ। বড় করে ঘাড় হেলালো দ্যুতি। উনি আমাকে একটা আদিবাসী গ্রামে নিয়ে যাবেন বলেছেন। কী যেন বললেন গ্রামটার নাম…চিনাকুড়ি, হ্যাঁ, হা, চিনাকুড়ি। ওখানে মেচ ট্রাইবরা থাকে। ওদের গাঁওবুড়োর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন বলেছেন মিস্টার শইকিয়া। ওই গাঁওবুড়োরাই আমাকে বলে দেবেন জেনারেশন আফটার জেনারেশন ওরা কোন সব ফোক লোর শুনেছেন…
দ্যুতির বাক্যস্রোতকে বাধা দিয়ে প্রমিত বলল, আপনি পারবেন মিশতে?
প্রমিতের এই কথায় এক নিমেষে দ্যুতির মুখটা কালো হয়ে গেল। বলল, পারব না, না? আমি জানি, আমার কমুনিকেশন স্কিল খুব পুওর। ভালো কথা বলতে পারি না।
এবার প্রমিতের অপ্রস্তুত হওয়ার পালা। সে কোনওরকমে বলল, না, না, আমি তা মিন করিনি। আসলে আমি আদিবাসীদের নিজস্ব কাস্টমসগুলোর কথা বলতে চাইছিলাম। সেগুলো না জানলে ওদের সঙ্গে মেশা একটু মুশকিল তো। কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না। ওইজন্যেই তো আপনাকে মিস্টার শইকিয়ার সঙ্গে ট্যাগ করে দিয়েছি। উনিই আপনাকে গাইড করবেন।
প্রমিত জানত দ্যুতি এই কথার পরেও তাকে ধন্যবাদ জানাবে না। জানালোও না।
দ্যুতিকে প্রথম দেখবার পর থেকেই প্রমিতের মনে একটা সন্দেহ হচ্ছিল। সেই সন্দেহটা মিলিয়ে নেবার জন্যে সে ডাকল, দ্যুতি!
উ? দ্যুতি সাড়া দিল।
একটা কথা জিগ্যেস করব, যদি কিছু মনে না করেন?
করুন।
আপনার পরিবারে কারা আছেন? মানে মা, বাবা, ভাই…
বাবা আছেন। আর স্টেপ মাদার। তবে ফ্যামিলির সঙ্গে আমার অ্যাটাচমেন্ট খুব কম। মা মারা যাবার পর থেকেই আমি হোস্টেলে থেকেছি, মানে আমার যখন সাতবছর বয়েস তখন থেকেই।
প্রমিতের সন্দেহটা মিলে গেল। এটিকেট ব্যাপারটা মানুষের সহজাত নয়। ওটা সংসারের অন্যদের দেখে শিখতে হয়। দ্যুতি সংসারে থেকেছে খুব কম।
তবে এটিকেট ব্যাপারটা প্রমিতের কাছে কখনওই খুব জরুরি কিছু বলেও মনে হয়নি। তার চেয়ে সিনসিয়ারিটির দাম অনেক বেশি। আর এই মেয়েটার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এর কোনও ভান নেই। একদম শিশুর মতন স্বচ্ছ চোখের তারা। শুধু সেই চোখের দৃষ্টি বইয়ের পাতা ছেড়ে ওঠে খুব কম।