বাকি থাকে তার নিজের কোয়ার্টার। কিন্তু সেই ব্যাচেলর কোয়ার্টারেই বা কে আছে, যে তার মাথার মধ্যে জমে থাকা এই গভীর বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি দিতে পারবে? যার সঙ্গে দুটো অন্য কথা বলে সে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভুলে থাকবে ভয়াবহ মৃত্যুর কথা? সেখানেও তো ঘরগুলো শূন্যতায় হা হা করছে।
না, কেউ নেই।
প্রমিতের মায়ের কথা মনে পড়ল। কলকাতা থেকে মাকে কয়েকদিনের জন্যে আনিয়ে নেবে? একটা ফোন করবে দাদাকে? তরপরেই মনে হল না, থাক। এবার যাওয়ার সময় মা বলেই গিয়েছিল, সামনে তোতনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা রয়েছে। সেটা শেষ না হলে আর এদিকে আসতে পারবে না। তোতন দাদার ছেলে। ক্লাস ফাইভে পড়ে। দাদা-বউদি দুজনেই চাকরি করে বলে ওর স্কুল যাওয়া, স্কুল থেকে ফেরত আসা এবং খাওয়া দাওয়া, সবটাই মায়ের হাতে৷ এই সময়ে মাকে নিয়ে চলে আসা মানে দাদা-বউদিকে বিপদে ফেলা।
শেষ অবধি আলিপুরদুয়ারে নিজের অফিসেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিল প্রমিত। কলকাতার অফিসের সঙ্গে একটু যোগাযোগ করে দেখা যাক বিমলদের ডেথ-বেনিফিটের টাকাগুলো তাড়াতাড়ি আনানো যায় কি না।
প্রমিত সিটের ওপর সোজা হয়ে বসে বলল, আলিপুরদুয়ার চল অশোক।
.
০৫.
আচ্ছা, আমার তাহলে এখন কী হবে?
প্রমিত আলিপুরদুয়ারে নিজের অফিসে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। সবে সকাল নটা বাজে। ভিজিটরদের ভিড় তাই একেবারেই নেই। জানলা দিয়ে প্রমিত দেখছিল, অফিস কম্পাউন্ডের মাঠে দুটো খঞ্জন পাখি দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে ওই পাখিদুটো ঠিক এই মাঠটিতেই মাইগ্রেট করে চলে আসে। সময় বা জায়গায় এতটুকু হেরফের। হয় না। গত দু-বছরে ওদের চিনে গেছে প্রমিত। পাখিদুটোর দিকে তাকিয়ে প্রমিত পরিযানের রহস্যের কথাই ভাবছিল। এমন সময়ে হঠাৎ ওই প্রশ্নে সে চমকে মুখ ফেরাল। দেখল দরজার কাছে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বয়েস বড় জোর তেইশ চব্বিশ বছর হবে। খুব রোগা, খুব ফরসা। এত ফরসা যে গলার কাছটায় নীল শিরা দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট মুখে কালো লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমাটা বড্ড ভারী লাগছে। মেয়েটার পরণে ব্লু জিনস এবং হাতা গোটানো সাদা কটনের শার্ট। এই কালার কম্বিনেশনটার মধ্যেও একটা স্কুল ইউনিফর্মের ছাপ আছে, যেটা মেয়েটার বয়েসকে আরও কমিয়ে দেখাচ্ছে।
প্রমিতকে নিরুত্তর দেখে দরজা পেরিয়ে ঘরের মধ্যে দু-পা এগিয়ে এসে আবার জিগ্যেস করল মেয়েটি আমি তা হলে কী করব এখন?
চশমার ফ্রেমটা বোধহয় একটু ঢিলে হয়ে গেছে, বারবার চোখের সামনে থেকে নেমে যাচ্ছে, আর মেয়েটা সেটাকে দু-আঙুলে যথাস্থানে তুলে দিচ্ছে। কিম্বা এমনও হতে পারে যে, যুবতী মেয়েটা তার বালিকাসুলভ চেহারায় এইভাবে কিঞ্চিৎ ভারিক্কীভাব আনবার চেষ্টা করছে। মনে মনে হেসে ফেলল প্রমিত। মেয়েটার চেহারা এবং হাবভাবে যে একটা কমিক্ ব্যাপার আছে, সেটা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।
আসুন, এখানে বসে বলুন আপনার সমস্যাটা কী? তা না হলে আমি বলব কীভাবে, আপনি কী করবেন? প্রমিত হাতের ইঙ্গিতে তার উলটোদিকের চেয়ারগুলোর মধ্যে একটা দেখিয়ে দিল মেয়েটাকে।
চেয়ারে বসার পরেও মেয়েটা ইতস্তত করছিল। যেন কোথা থেকে কথাটা শুরু করবে বুঝতে পারছিল না। প্রমিত তাকে সাহায্য করল–আপনার নামটাই বলুন আগে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। প্রমিতের প্রস্তাবটা যেন লুফে নিল মেয়েটি। আমার নাম দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত। পুরো নামটা অবশ্য কেউই বলে না। দ্যুতি বলেই ডাকে সক্কলে।
এইটুকু বলেই ব্যস, আবার চুপ। মোটা লেন্সের মধ্যে দিয়ে বড় বড় দুটো চোখ মেলে ঘরের চারপাশের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ বাদে প্রমিত বাধ্য হয়ে বলল, কী যেন একটা সমস্যার কথা বলছিলেন।
অফিসের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা বক্সার ম্যাপের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটি বলল, কই? সমস্যার কথা বলিনি তো।
তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এইভাবে বলল, ও, হ্যাঁ। আপনারা যে জঙ্গলে ঢোকা বারণ করে দিলেন, আমি এবার কী করব তাহলে?
ব্যাপারটা সামান্য হৃদয়ঙ্গম হল প্রমিতের। বিমল, বাবুয়ারা মারা যাবার পরেই প্রথম স্টেপ যেটা সে নিয়েছে, সেটা হল হরিণডুবি থেকে উত্তরদিকে কারুর যাতায়াত বারণ করে দিয়েছে। ওইদিকেই ভূটান সীমান্ত, ওইদিকেই বিপদ। এমনিতে তাতে কারুর বিশেষ অসুবিধে হবার কথা নয়, কারণ ওদিকে কোনও লোকালয় নেই। মাঝেমধ্যে শিলিগুড়ি কিম্বা কলকাতা থেকে ভ্রমণপিপাসু ছেলেমেয়েদের দল আসে। জয়ন্তীর জলধারার পাশ দিয়ে, ভুটানপাহাড়ের কোল ঘেঁষে ওই স্বর্গের মতন সুন্দর পথে কিছুটা ট্রেক করে আসে তারা। একমাত্র তাদেরই এখন আটকে দেওয়া হচ্ছে। ওরা বাদে সোনারু মাঝির মতন লোকাল লোকজন, যারা বিভিন্ন প্রয়োজনে জঙ্গলে যেত, তারা নিজেরাই ওই ঘটনার পরে এমন ভয় পেয়ে গিয়েছে যে, উত্তরের জঙ্গলের দিকে পা বাড়াবার কথা মুখেই আনছে না। প্রমিত জিগ্যেস করল, আপনি কি কোনও ট্রেকিং দলের সঙ্গে এসেছেন?
আবার বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে প্রমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটি, মানে দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত। যেন ট্রেকিং শব্দটাই সে এই প্রথম শুনল। তারপর বলল, না তো। আমি একাই এসেছি। আমি রিসার্চের কাজে এসেছি।