তুলিকা বুঝতে পেরেছে কে এই পরিণতির জন্য দায়ী। শ্যামলমামা কেন এত বস্ত্র পর কলকাতায় ফিরে এসে আবার দিদির দিকে হাত বাড়াতে চাইছে? নিজেরও
তো সংসার রয়েছে। এ বাড়ির ঠিকানাই বা ওকে কে দিয়েছে?
তুলিকা জিজ্ঞেস করলো, এখানে শ্যামলমামাকে কে নিয়ে এসেছিল?
সুমিত্রা মাসি। তারপর থেকেই এ বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলো। সপ্তাহে পাঁচ দিন। অফিস থেকে চলে আসে প্রতিদিন দুপুর দেড়টা-দুটো নাগাদ। বাড়িতে তখন একা কাবেরী। ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর কোনও বাধা থাকে না। দু’জনে নিশ্চিন্তে দৈহিক সান্নিধ্য উপভোগ করে। আমার নজরেও পড়েছিল। আমি প্রতিবাদ করতে পারিনি। এই ব্যাপার নিয়ে চেঁচামেচি করলে বাড়ির অন্য ভাড়াটে বিদ্রুপের খোরাক পেয়ে যাবে। এমন কেচ্ছা নিয়ে রসালো আলোচনায় সকলে মেতে উঠবে।
কিন্তু প্রতিদিন দুপুরে দিদির কাছে যে পুরুষ আসে, তাকে নিয়ে কৌতূহল জাগবে না, এ কথা কি আপনি বিশ্বাস করেন? অস্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে না উঠলে কেউ কি প্রতিদিন আসে? আপনি বৃথাই গোপন করে রাখার চেষ্টা করছে। আমার ধারণা, শুধু এই বাড়ির সকলে নয়, পাড়া প্রতিবেশীরাও জেনে ফেলেছে। আপনার কানে কি কখনও কোনও কটুক্তি গিয়ে পৌঁছয়নি।
তুলিকা ঠিকই অনুমান করেছে। কয়েকদিন আগে অফিস থেকে ফেরার পথে সুশান্ত দেখেছিল ওর দিকে লক্ষ্য করে পাড়ার একটি যুবক বন্ধুদের বলছে, উনি চরতে বেরিয়েছে সেই দুপুরে। বেশ ফুর্তিতে আছেন।
কাবেরীই যে ওদের উপহাসের পাত্রী, বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি সুশান্তর। ওদের কোনও দোষ নেই। ওদের উৎসাহিত করার জন্য প্ররোচনা যুগিয়েছে কাবেরী নিজেই।
সেদিনই সুশান্ত কাবেরীকে সংযত করার প্রয়াসী হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। কাবেরী বলেছিল, তুমি যদি আমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করো আমি আত্মহত্যা করব।
স্ত্রীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত হলে, পুলিস-আইন-আদালত জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলবে। সেই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে করতে নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। কাবেরী শেখানো অস্ত্র প্রয়োগ করে সুশান্তকে পুরোপুরি বশে আনতে পেরেছিল। কাবেরীর গর্ভে যদি শ্যামলের ঔরসজাত সন্তান আসে, তাতে একটুও অবাক হবে না সুশান্ত। কিন্তু অবৈধ সন্তানের পিতৃত্বের দায় ওকেই বহন করতে হবে লোকলজ্জার ভয়ে। ওই নির্মম ও নিষ্ঠুর পরিহাসের শিকার হয়েও কাবেরীর সঙ্গে ওর সব বন্ধন ছিন্ন করার কথা এখনও ভাবতে পারেনি সুশান্ত।
তুলিকা চলে যাবে। ন’টা বাজে। বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে। দিনকাল ভালো নয়। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সংঘর্ষ ক্রমশই বাড়ছে। রাতের অন্ধকারে ও যেন ওদের প্রতিদিনের উৎসব। ঘর থেকে বেরোতে যাবার মুখে তুলিকা আচমকা মুখোমুখি হয়ে গেল কাবেরীর। তুলিকাকে দেখেই কাবেরী একটু থতমত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, তুই আমাকে না জানিয়ে হঠাৎ এসেছিস কেন?
কাবেরীর এমন প্রশ্নে আহত হয়ে তুলিকা বলল, এ বাড়িতে আসতে হলে আমাকে যে তোর কাছ থেকে আগাম অনুমতি নিতে হবে, আমার জানা ছিল না। তুই বলে ভালোই করেছিস। এবার থেকে…
আমি তোকে অনুমতি নিতে বলিনি। না জানিয়ে এলে আমার সঙ্গে তোর দেখা হবার সম্ভাবনা কম।
জানি। তুই আজকাল রাত এগারোটার আগে বাড়ি ফিরিস না। অবশ্য তুই কোথায় যাস, কি করিস, আমি বলতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় তুই বোধহয় একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস। যে সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাকে তুই আবার বাঁচিয়ে তুলেছিস কোন আশা নিয়ে? তুই সুশান্তদার…
কাবেরী তুলিকার এই ভূমিকাকে মেনে নিতে না পেরে বলল, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে তুই নাক গলাতে চাইছিস কেন? তুই যদি এই কথা বলতে আজ এখানে এসে থাকিস, তবে আমি তোকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, তুই আমাকে না জানিয়ে আর কোনওদিন আসিস না।
আমি আসবো না। কিন্তু তুই কি ভুলে গেছিস, একদিন আমাদের বলেছিলি তোর এই গোপন সম্পর্কের কথা সুশান্তদার কাছে ফাস না করে দিতে? সেদিন আমরা তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবকিছু গোপন করে রেখেছিলাম। আজ সুশান্তদা আমাদের অভিযুক্ত করতে চাইছেন। আমরা কি জবাব দেব বলতে পারিস?
তুলিকা এভাবে গোপনীয়তার আড়াল ভেঙে সুশাস্ত্র কাছে আসল সত্যকে উন্মোচিত করে দেবে ভাবতে পারেনি কাবেরী। কিন্তু শ্যামলমামার উষ্ণ স্পর্শ ছড়িয়ে আছে সারা শরীরে তাকেই বা অস্বীকার করবে কিভাবে? সুমিত্রামাসিকেই দায়ী করতে চায় কাবেরী। তিনি কেন ঘনিষ্ঠতা বাড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে? কাবেরীকে নির্বাক দেখে তুলিকা উত্তরের প্রত্যাশা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুশান্ত এই মুহূর্তে কাবেরীকে একজন বেশ্যা ছাড়া অন্য কোনও বিশেষণে ভূষিত করতে পারলো না। সুশান্ত ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, কাল থেকে তুমি বাড়িতে ফিরো না। ওই পাড়ায় ঘর ভাড়া নিয়ে থেকো। ওখানে থাকলে তুমি তোমার ইচ্ছেমতো শয্যাসঙ্গী বদলাতে পারবে।
কাবেরীর সামাজিক অস্তিত্বে আঘাত করে একেবারে নিঃস্ব করে দিতে চাইলে সুশান্ত। তবু প্রবািদের ভাষা খুঁজে পেল না কাবেরী। শ্যামলমামা কাছে এসে দাঁড়ালে শরীর যে সঙ্গ পিপসায় ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। এই সংসার, এই পরিবেশ, যার সান্নিধ্যে এতদিন ধরে প্রতিটি মুহূর্তে কাটিয়েছে, তাকে অস্বীকার করে বেরিয়ে যেতেও দ্বিধাবোধ করে না। শুধুমাত্র শরীরী আকর্ষণ! নাকি একদিন যাকে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছে, সেদিনের শূন্যতা আজ অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। ফিরে পাওয়া হারানো পুরুষকে।