একটা গাড়ি আসছে। তার জোয়ালের একদিকে গরু, অন্যদিকে মানুষ।
গাড়ির ধুরিতে তেল পড়েনি কোঁ কোঁ আওয়াজ বেরুচ্ছে।
লোকটা রোগা। পরনের ময়লা লুঙিটা বেশরমভাবে কাছা মারা দুই জাং আর পাছার অনেকটা উদোম কবর থেকে মরা মানুষ উঠে এসে যেন গাড়িতে বাঁওয়ালি’ টানছে। এ বড় তাজ্জব!
বদর হাজি নানা জায়গা ঘোরা মানুষ। কলকাতায় মানুষটানা ঠেলাগাড়ি আর রিকশো দেখেছেন কিন্তু ভট্টমাটির পথে এমন কখনও দেখেন নি জিভ চুকচুক করে বললেন—আহা বেচারা! তাঁর মন এমনিতে নরম গরীব-মিশকিনকে ভিক্ষে দেনা মুসাফির দেখলে ডেকে খাওয়ানা ভাই রে! এ সংসার ক’দিনের? এক পা গোরে দিয়েছি।
নাদুস-নুদুস শরীর ধুপধুপিয়ে বদর হাজি উঁচু পুকুরপাড় থেকে রাস্তায় নেমে গেলেন। মিঠে গলায় বললেন—বাড়ি কোথা, বাপ?
হারাই দাঁড়ায়। শুকনো ঠোঁটে একটু হেসে সালাম বলে ক্ষীণ স্বরে। চোখের কোণায় গর্তা ফের নাম বলল। ধাম বলে। মেদীপুরের বাজার থেকে গাড়ি ছেড়েছে দুপুরের নমাজ পড়ে। চিড়ে গুড় দিয়ে ক্ষিদে মিটিয়েছে। সেই সব কথাও বলে। বদর হাজিকে তার মেহেরবান মনে হয়। মনের সব দুঃখ খুলে বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শরমের চাপে ধনাকে বেচার কথাটা লুকোয়। শুধু বলে, বাঁওয়ালি গরুটা রাস্তায় মারা পড়েছে।
বদর হাজি সব শুনে জিভ চুকচুক করে বলেন—আহা! তাহলে তো বড়ই মুশকিল কিন্তু বাড়ি বুললে তো সেই পদ্মার ধারে শিমূলে-কেষ্টপুর! সে তো কমপক্ষে বিশ কোশের মাথা! দু লদীর পার, তিন লদীর কিনারে!
—জী হাঁ! জী হাঁ। হারাই খুব সায় দেয়।
বদর হাজি একটু রাগ করে বলেন—বুলছ তো জী হাঁ! তুমরা বাঘড়ে গাড়োয়ানরা বেজায় বোকা!
হারাই খালি দাঁত বের করে।
—এক কাম করো।
—কী?মুশকিলআসান হাজিসায়েবের কথা শুনে হারাই বড় প্রত্যাশায় তাকিয়ে থাকে।
হাজি বলেন—আমার উখানে তুমাদের বাঘড়ীর একদল গাড়োয়ান এসেছে। আজ রেতেই উয়ারা চলে যাবে বুলছিলা বুঝলে?
—জী, জী।
—আমি বুলে দিব উয়াদের। কারুর পেছনে জুতে দিও গাড়ি। ওই তো কখান বস্তা কী আছে ওতে?
—ধান, বাপজী।
বাপজী শুনে দয়ালু বদর হাজি বলেন—দেখ দিকিনি কী বিপদ! অমন একলা দলছাড়া হয়ে আসে রে, বাবা?
সুখে দুঃখে আবেগাপ্লুত হারাই বলে—চণ্ডীতলার চারু মাস্টেরের বিটির বিভা হবে ফাগুন মাসে। হামার একটা ভাই আছিল। তিনি কথা দিয়ে এসেছিল, বিভার কুমড়া-কলাই যা লাগে দিবো ভাইয়ের জবান, বাপজী হাজিসায়েব! সেই ভাই হামার এখুন গোরে! সে চোখ মোছে। নাক ঝাড়ে।
হাজি বলেন—এস, এস কপালের ফের আর কী! আর কক্ষনো অদূর থেকে অমন করে একা। এসো না। শিমূলে-কেষ্টপুর সে কি ইকেনে? দুই লদীর পার। তিন লদীর কিনারে। সেই লালগোলার মুখে ওপারে গোদাগাড়ি ঘাট জেলা রাজশাহী এই সেদিনেও ইস্টিমার চলত। কী সব হেঁদু-পাকিস্থান করে গোল বাঁধালে। …
বদর হাজি আগে আগে হাঁটেন। পদ্মাপারের গল্প বলেন। পাকা মানুষ কত দেশ ঘুরেছেন। আরও দ্যাখ বাপ, দ্যাশচরা মানুষের কাছে সব বিদ্যাশীই আপন। কত জায়গায় গিয়ে ঠেকেছি। আলাপ-পরিচয় হয়েছে। কুটুম্বিতে করেছি। তাই বিদ্যাশী সবাই আমার মেহমান। অতিথি যা আছে, খোদার ফজলে, তাই খেতে দিই। চাট্টি ডালভাত খাবি, বাপ। শরম করিস না তুই আমার মেহমান …
দলিজ ঘরের সামনে মস্তো চটান। খামার বাড়ি। শীতের ধানটা ওখানেই ঠ্যাঙানো হয়েছে। চকচকে গোবরলেপা মাটি এক পাশে খড়ের পালা সার সারা খামারের কোণার দিকে বাঘড়ে গাড়োয়ানদের গাড়িগুলো রয়েছে। মাথার ওপর ডালপালা ছড়ানো শিরীষ গাছ। ইটের উনুন জ্বালিয়ে গাড়োয়ানরা রান্নাবান্না করছে। রাতের নমাজের পর খেয়েদেয়ে গাড়ি ছাড়বে। হারাই কিন্তু নিরাশই হল। ওরা যাবে কাতলামারির দিকে। বহরমপুর থেকে ছাড়াছাড়ি হবে। তখন ফের হারাইকে গাড়ি টানতে হবে। শেষে ভাবল, যদূর যাওয়া যায়। পথে যদি কপালগুণে নিজের এলাকার কোনও দল পেয়ে যায়, ভালই হবে
দল বেঁধে সবাই নমাজ পড়ে এল পাশের মসজিদে। তারপর ওরা খেতে বসল গাড়ির কাছে। হারাই বদর হাজির মেহমান বড় আশায় সুখে মনটা চনমন করছে। ঘরের ভেতর তক্তপোশে নকশাআঁকা সাদা দস্তরখানা পড়ল। মৌলবি হাত ধুয়ে তৈরী হয়ে বসলেন। বদর হাজি ডাকলেন—আয় বাপ হারুন আলি! হারাই সংকোচে এক পাশে বসলা আমির-বড়লোকের সঙ্গে জীবন। এই প্রথম সে খাচ্ছে। জীবনের সব দুঃখ, বঞ্চনা, হারানোর শোক ক্ষোভ আর ধনার মৃত্যুর কথা সে ভুলে গেল। তার সামনে বিশাল খাঞ্চায় ভরা শাহদানার পা সাদা ঝকমকে স্বাদু সুগন্ধ রাঢ়ী অন্ন। বাড়ি ফিরে বউছেলেপুলের কাছে কত গল্পই না করবে হারাই! তার বংশে এটা একটা গল্প হয়েই থাকবে বইকি—এই বংশের এক পুরুষ আমির-বড়োলোকের সঙ্গে বসে একই খাঞ্চা থেকে ভাত আর একই বাটি থেকে তরকারি তুলে খেয়েছিল!
শরীয়ত মতে খেতে বসে খামোকা কথা বলতে নেই। তবু বদর হাজি একটু গপ্পে মানুষ। হঠাৎ হেসে মৌলবিসায়েবকে বলেন—আপনার বরাতে ছিল! তারপর মেহমান হারাইয়ের দিকেও তাকান।–তোরও বরাত, বাপ!
হারাই মুখ তোলে। মৌলবি বলেন—জী?
বদর হাজি একটা প্রকাণ্ড চীনেমাটির বাটি থেকে চামচে কী একটা তরকারি তুলে আগে মৌলবির থালায় দেন। তারপর কয়েকটা টুকরো তুলে হারাইয়ের থালায়, শেষে নিজে থালায় নিলেন। তারপর হাসতে হাসতে বলেন—আমাদের গাঁয়ে এই এক জ্বালা হেঁদু জমিদারের মাটি। বাপপিতেমোর আমল থেকে চলে আসছে এই নিয়ম এ মাটিতে হালাল হয় না।