আজ হাটবার। মেদীপুর চটির হাটতলা ক্রমশ ভরে উঠছে মানুষে। বটতলায় একটা দুটো করে গাড়িও এসে জুটছে। আশেপাশের গাঁ থেকে এসেছে হাট সারতে। তারা হারাইকে হাজার কথায় উপদেশ দেয়া আর কেউ কেউ বলে—বেচে দাও কসাইকে হালাল করুক। অমনি রাগী লাল চোখে তাকায় হারাই। মাথাটা দোলায়। কেউ বলে—বাঘড়ীর গাড়ির ঝাঁক আসবে যখন, তাদের গাড়িতে বস্তাগুলো তুলে দিও। আর গাড়িটা একটা গাড়ির পেছনে বেঁধে দিও। তবে রোগা গরুটা…
একজন হেসে বলে—রোগা গরুটা আর কতক্ষণ? হুই দ্যাখো, কাছেই পুকুরপাড়ে ভাগাড়।
হারাইয়ের ঠোঁট কাঁপো কথা বলে না। চারপাশে এই ভিড় তার দমকে আটকে দিয়েছে। ধনারও দম আটকে দিচ্ছে। হাওয়া চাই, অনেক হাওয়া। দোহাই বাবাসকল, একটু ঘুরে দাঁড়াও। হামারঘে এটু হাওয়া বাতাস দাও। মনে এই করুণ মিনতি বুজকুড়ি তোলে। চোখ দিয়ে জল গড়ায় নিঃশব্দে একটি অসহায় মানুষ আর একটি রুগণ জানোয়ারের। ক্রমে বেলা বাড়ে। কোলাহল বাড়ে। একের পর এক মানুষজন এসে ভিড় করে আর চলে যায়। শেষ কথা বলে যায়। তারপর ভিড় ঠেলে আসে কেউ। –আসসালাম আলাইকুম, ভাইজান!
হারাই তাকায়। সেই দিলজান! টেরি করা তেলচুকচুকে চুল চিবুকে দাড়ি। গায়ে হাফ শার্ট, বুকপকেটে কাগজ কলম। পরনে চেককাটা লুঙি আর পায়ে পাম্পসু কাঁধের গামছায় ঠোঁটের পানের রস মুছে হাসে। হারাই চোখ নামিয়ে ধুলোয় আঁক কাটে। কাল রাতে এই লোকটাই কি তাকে গালমন্দ করেছিল? বিশ্বাস হয় না। মুখে মিঠে হাসি।
–কী ভাই? কী ঠিক করলেন?…দিলজান পাশে এসে বসে। কাল সন্ধেবেলা বুলেছিলাম পঞ্চাশ। তখন অবস্থা ভাল ছিল। এখন তিরিশেও রাজী হব কিনা বলা কঠিন। বলুন তাড়াতাড়ি
হারাই গলার ভেতর বলে–কী?
—ভুল করবেন না তিরিশ টাকা কম নয়। লিয়ে যেতে যেতে যদি জান বেরিয়ে যায়, সব টাকা বরবাদ কি না বলুন! আমি ‘রিসিক’ লিচ্ছি। দেরী যত করবেন, তত দুজনারই ক্ষেতি।
চার পাশ থেকে সবাই সায় দেয়া এক গলায় বলে–দিয়ে দাও, দিয়ে দাও। কেউ বলে— হালাল জিনিস। মানুষের ভোগে লাগুক। ক্যানে শেয়াল শকুনকে খাওয়াবে বাপু! এবং ফের দিয়ে দাও, দিয়ে দাও, এই কোরাস ব্যুহের মতো ঘিরে ফেলে হারাইকে। দিলজান পকেট থেকে টাকা বের করো লেন। হাত পাতুন। তারপর সে হারাইয়ের আড়ষ্ট হাতে তিনটে নোট গুঁজে দেয়। মুঠোটাও চেপে বুজিয়ে দেয় এবং ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ায়। কাকে ডেকে বলে—শিগগিরি গাড়ি জুতে আন। হাঁটতে পারবে না। জলদি যাবি। তারপর সে ব্যস্তভাবে ধনার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
হারাই টাকা মুঠোয় নিয়ে বসে থাকে। দু চোখে শব্দহীন জল বয়ে যায়। একজন বলে—আহা! আর কেঁদে কী হবে, ভাই? গোজন্মে খালাস পেল। বেঁচে গেল, তাই মোনে করো। তবে হ্যাঁ, বেথা তো হবে। পালা জন্তি কত আদর খেয়েছে। বেথা বাজবে বই কি। ওরে ভাই, নিজের জোয়ান ব্যাটা যে মরে যায়, তার বেলা?
হারাই লোকটাকে দেখতে থাকে। লোকটা ঢ্যাঙা গোঁফ আছে মস্তো খালি গা, পরনে মালকোচ করা ধুতি বগলে তেল পাকানো লাঠি। কোমরে লাল গামছা জড়ানো। খৈনি ডলছে। লোকটা হিন্দু তা বুঝতে পারে হারাই। খৈনি জলে সে তালুতে চটাস শব্দ করে ফু দিতে দিতে ফের বলে—দিলজান আছে বলে অ্যানেক লোকসান বাঁচে। যা পাওয়া যায় দু দশ টাকা, এ বাজারে তাই লাভা বরঞ্চ ওই টাকায় একটা বাছুর কেনো। ইচ্ছে থাকলে ইভেনেও কিনতে পারো আমার কাছে। সস্তা করে দেব। দেখবে নাকি হে?
হারাই মুখ নীচু করে শুধু বলে—বাছুর বড়ো হতে হতে মনা গোরে যাবে, হামি ভি গোরে যাব, দাদারে!
ভট্টমাটির বদর হাজি মাঠে গিয়েছিলেন। দেড় বিঘে জমির আখ কাটা হচ্ছে। আজই দুপুর বেলা মোষের গাড়িতে মাড়াইকরা কল আর কড়াই আনা হয়েছে মউলে থেকে। বাড়ির পাশে বাঁশবনের ভেতরে বসানো হচ্ছে। হাজি গিয়েছিলেন আখ কাটার তদারকে। মাঝ রাত নাগাদ তাঁরই আখ দিয়ে মরসুমের গুড় তৈরির পালাটা শুরু হবে। ইমানদার তীর্থফেরত মানুষ আল্লার নেকনজর তাঁর ওপর। গাঁয়ের সব কাজ তাঁকে দিয়েই শুরু হয়। বিশেষ করে গুড় তৈরিতে আবার। পয়-অপয় বা ভাল-মন্দ সাইতে’র ব্যাপার আছে। জ্বাল দিচ্ছে তো দিচ্ছে, রসে আঠা ধরে না। কিংবা আঠা ধরল তো এমন ধরা ধরল, চিটে হয়ে গেল। সু-কুয়ের দৃষ্টি আছে। দোয়াদরুদ। পড়তে হয়। শয়তান খেদাতে হয়। সে অনেক ঝক্কি। বদর হাজি মক্কা থেকে পবিত্র আবে-জমজম (জমজম নামক কুয়োর জল) এনে রেখেছেন। ফুটন্ত রসে একটু ছেটালেই বরণ ধরে উজ্জ্বল সোনালী। আর কী স্বাদ! বদর হাজির মুখের বচনের মতো স্নিগ্ধ আর মিঠো ওঁর মনের মতো নরম।
হাজির পরনে হাঁটু অবদি ঝুল পাঞ্জাবি। গোড়ালির ওপর থেকে লুঙ্গির ঝুল। পায়ে থ্যাবড়া চটিা কাঁধে বিহারের দেওবন্দ শরীফের হলুদ ডোরাকাটা গামছা—এক মৌলবির কাছে কেনা। তিনি সেখানকার বিখ্যাত মাদ্রাসায় সবে পাস দিয়ে এসে ভট্টমাটিতে মক্তব খুলেছেন। ডেরা। গেড়েছেন হাজিসায়েবের দলিজ ঘরে।
আর বদর হাজির মাথায় আরবী গোল টুপি। মক্কার বাজারে কেনা। হাতে এনামেলের বদনা। আখ কাটা মুনিষদের মিঠে কথায় তম্বি করে চলে এসেছেন রাস্তার ধারে পুকুরপাড়ে। তালগাছগুলো ন্যাড়া করে পাতা কাটা হয়েছে। সেগুলো দিনমান রোদে ক’দিন ধরে শুকোচ্ছে। গুড়ের চুলোয় জ্বালানী হবে। হাজি রোজ দুবেলা এসে একটা একটা করে গুনে যান। একটু আগে। বিকেলের নমাজ সেরে পাতা গুনছেন। হঠাৎ চোখ গেল রাস্তায়। থমকে দাঁড়ালেন।