দিলজান আর সহ্য করে না অশ্লীল গাল দিয়ে বলে—এ জন্যেই বলে বাঘড়ে ভূতা শালোর মাথায় ভূত ঢুকেছে। জাতভাই বলে দয়া হল আর শালা বোলে কি না আজরাইল! মুখ সামলে কথা বলবি, শালো!
রাগী দিলজান হন হন করে হেঁটে সামনের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। হারাই দু কাঁধে দুই চোখ ঘষে নেয়। তারপর তার চমক খেলে। কলজে সিরসির করে ওঠো ও কে এসে তাকে লোভ দেখাচ্ছিল? সে ভয়ে ভয়ে পিছু ফিরে ধনাকে দেখে নেয়। কে ওই লোকটা, অন্ধকারে কখন তার পিছু নিয়েছিল? ও কে? হারাই বিড়বিড় করে বলে—ধনা! ডর পাসনে বেটা। হামি আছি। তারপর থেকে বারবার তার চমক খেলে মনে হঠাৎ পিছনে, পাশে, সামনে অদৃশ্য দিলজান এসে দাঁড়ায়। তার হাতে ছোরা চকচক করে। ক্রমে অন্ধকারে তার মূর্তিটিও যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠো হারাই তখন বিড় বিড় করে দেওয়া আবৃত্তি করে রাতবিরেতে রাস্তায় চলা যাদের জীবন, তারা। ‘দোওয়া গঞ্জেল আরশ’ মুখস্থ রাখো হারাইয়ের বাপ হারাইকে ছেলেবেলায় এই দোওয়া শিখিয়ে দিয়েছিল পথেঘাটে বিপদ-আপদে পড়লে এই দোওয়া আওড়াস বেটা বালা-মুসিবত দূর হয়ে যাবে। ভূত-ভূতিনী, জিন-পরী কী চোর-ডাকাত একতিল ক্ষেতি করতে পারবে না। বিপদ যত বেশি হবে, তত জোরে জোরে পড়বি ‘গঞ্জেল আরশ’।
সুতরাং হারাই ভয়-কান্না-ক্ষোভ মেশানো কাঁপা কাঁপা সুরে জোরালো গলায় ‘গঞ্জেল আরশ উচ্চারণ করতে থাকে। আর চাকায় চাকায় বাজতে থাকে সুরে সুরে মিলিয়ে চারু মাস্টারের বেহালা। নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে ছড়িয়ে আসে পরম করুণামাখা আশ্বাস।
হারাই যখন মেদীপুর চটির কাছাকাছি, তখন কৃষ্ণপক্ষের আধমরা চাঁদটা মাঠের ওপর ভেসে উঠেছিল সেই ক্ষয়াটে জ্যোৎস্নায় সামনে দূরে যেন একবার দিলজানকে দেখেছিল—চোখের ভুল হতেও পারে। পিছনে তখন ধনার খুরের শব্দটা বেশি করে শোনা যাচ্ছিল। বার বার ঘুরে দেখছিল, ধূর্ত কসাইটা পিছন ঘুরে গিয়ে ধনার দড়ি খুলে দিচ্ছে নাকি! কিন্তু পিছনে খুরের শব্দ জোরালো আর ধারাবাহিক। ধনা আর হাঁটতেও পারছে না, তাই ওই শব্দ। তবু ওই শব্দেই তো সে তখনও বেঁচে আছে। বার বার তাকে সাহস দিচ্ছিল হারাইডর কী? আমি তো আছে!
চটির ধারে বটতলায় একদঙ্গল বাঘড়ে গাড়োয়ান ছিল, তার প্রমাণ ছড়ানো তারা সন্ধ্যায় চলে গেছে। একলা হারাই গাড়ি রেখে রাত জেগেছে। চোখের পাতা কষ্টে খুলে রেখেছে। কী জানি কখন দিলজান কিংবা কেউ গরু খুলে নিয়ে যায়! আর এই তিন বস্তা সোনা গাড়ির ওপর রাখা!
কিন্তু খিদেয় পেট চোঁ চোঁ। পিরিমল বদ্যি পকেট খালি করে দিয়েছে। অগত্যা বস্তা খুলে কিছু ধান গামছায় বেঁধে চিঁড়ের দোকানে গিয়েছিল সে। চিড়ে আর ভেলি গুড় কিনে খেয়েছিল। শুয়ে পড়েছিল ধানের বস্তায় ঠেস দিয়ে। ধনা আরও কাহিল হয়েছে। ছ্যারানি বেড়ে গেছে। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে মন্ত্রপড়া জলটা খাইয়েছে হারাই। আশায় থেকেছে, শেষ রাত নাগাদ গরুটা নিশ্চয় ভাল হয়ে যাবে।
ভোরে কোথায় আজানের শব্দ শুনতে পেলা কী একটা স্বপ্ন দেখছিল, মনে পড়ল না হারাই হুড়মুড় করে উঠে বসলা সারা শরীরে ব্যথা। জ্বর ভাব। আর শেষ রাতে বেজায় জাড় পড়েছিল। গরু দুটোর পিঠে ছালা চাপানোর কথা মনেই ছিল না। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সে আগে ধনার দিকে তাকায়। কলজে চিরিক করে ওঠো গরুটা দু পায়ের ওপর মুখ রেখে শুয়ে আছে। চোয়াল অল্প অল্প নড়ছে। পিঠে হাত বোলায় কিছুক্ষণ তারপর মন্ত্রপূত এক আঁজল জল ফের ঠোঁটের কাছে ঝাপটানি মেরে ছুঁড়ে দেয়া কষায় গড়িয়ে পড়ে।
আর সেই আজানের কাঁপা কাঁপা সুরে অসহায় হারাইকে ঈশ্বরের দিকে মুহুর্মুহু ডাকতে থাকে। সে ঝটপট পাশের পুকুরে অজু (প্রক্ষালন) করে গাড়ির একটু তফাতে পরিষ্কার জায়গা বেছে নেয়। শুকনো ঘাসে দাঁড়িয়ে নমাজ পড়ে মাথা কোটো হুহু করে কেঁদে বলে—হামার বেটার জান মাঙি হুজুর আর কিছু মাঙি না সংসারে তারপর কী এক হঠকারিতায় আচ্ছন্ন গাড়োয়ান চুপি চুপি ফের বলে—হেই পরোয়ারদিগার! হামরা মাগমরদ বাঁজা লই তুমার মেহেরবানিতে। তুমি এক ব্যাটার জানের বদলে হামারঘে আরেক ব্যাটার হায়াত (আয়ু) দাও!
ব্যাটা মরবে, ব্যাটা জন্মাবে। কিন্তু গরু মলে গরু কোথায় পাবে হারাই! একটা গরুর দাম যোগাতে আদ্ধেক জমি বেচতে হবে। খোদা কি এটা বোঝেন না? একটা গরুর অভাবে তার গাড়োয়ানী বন্ধ হবে চাষবাস বন্ধ হবে। খন্দ ফলমূল ফিরি করতে আসা হবে না রাঢ়ে। বাঘড়ীমুলুকে কে এসব কিনবে? না খেয়ে মারা পড়বে হারাইয়ের বহু-বেটা-বিটিরা। ‘মুসাফির’দের মতো তাদেরও যে মরসুমে ভিখ মাঙতে যেতে হবে রাঢ়ে। ঠিক এমনি করে একটা গরুর অভাবে বাঘড়ীর কত মানুষ মুসাফির ভিখিরী হয়ে গেছে। তাই ভেবে হারাই কাঁদে। নমাজে বসে থাকে অনেকক্ষণ খোদাতালাকে ইনিয়ে বিনিয়ে সব কথা বোঝাতে চায়।
রোদের ছটা ফুটেছে মেদীপুরের গাছগাছালির মাথায় হারাই যখন গাড়ির কাছে এল, তখন একটা দুটো করে লোক জমেছে দোকানপাটে। তারপর ভিড় বাড়তে থাকে। সূর্য উঠল। আবার কিছু ধান দিয়ে হারাই চিড়ে গুড় এনে খেলা ধনা তেমনি শুয়ে আছে।
তারপর যত বেলা বাড়ে, একটা দুটো করে লোক এসে হারাইয়ের গাড়ির কাছে দাঁড়ায়। ওরা কীভাবে টের পেয়ে গেছে বুঝতে পারে না হারাই। আসলে গাঁ-গেরামের মানুষ গরু-অন্ত প্রাণ। গরুর কিছু হলে ভিড় করে আসবেই। প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে হারাই কোণঠাসা। নানান জনে। নানান ওষুধ বাতলায়। কেউ বলে—বাঁচবে না। কেউ বলে—বাঁচতেও পারে। অনেকে রোগা গরুর কাহিনী শোনায়। হারাই চুপচাপ বসে থাকে। আশা-নিরাশায় টানাপোড়েন চলতে থাকে মনের ভেতরে।