কাচ ভাঙা লণ্ঠন যথেষ্ট আলো দেয় না। ফাটলে কাগজ গোঁজা। সেই হেরিকেন তুলে লোকটা ধনাকে দেখতে থাকে। সামনে থেকে পেছন অবদি দেখে এবং গায়ে একটা হাত রাখো ধনা কেন যেন নড়াচড়া করে। শিঙ নাড়ে। পা ঠোকো হারাই মনে আশা নিয়ে ভাবে, এও এক বদ্যি। লোকটার পরনে চেককাটা লুঙি, গায়ে হাফশার্ট, কাঁধে গামছা ঝুলছে। টেরিকরা তেল চুকচুকে চুল। চিবুকে দাড়ি আছে একটুখানি পানের রসে ঠোঁট লাল। তার পায়ে পাম্পসু জুততা আর কাঁধে ঝোলা ঝুলছে। হারাই বুঝতে পারে, কাঁদির টাউনে গিয়েছিলা বাড়ি ফিরছে। বাসভাড়া ফুরিয়ে গেছে হয়তো হারাই বিবেচনা করে। হু লোকটা সুখী লোক। মুখের ভাবে সেই ভাবা আর রাঢ়ে তো সবাই সুখী। রাঢ় দ্যাশ সোনার দ্যাশা সাদা ঝকঝকে স্বাদু সুগন্ধ শাহদানা খায় দুবেলা। রো-ও-জ খায়! ভাবা যায়? দুবেলা ভাত, তিরিশ দিন বারো মাস বছরের পর বছর!
রাঢ়ী লোকটা ধনাকে দেখার পর শুকনো ঘাসগজানো একরাশ পাথরকুচির ওপর হেরিকেন রাখো তারপর বসে হাঁটু দুমড়ো হারাইও বসে লোকটা পকেট থেকে বিড়ি বের করে বলে— চলে ভাই?
হারাই মাথা দোলায়।
সে বিড়িটা ধরিয়ে বলে—আমার নাম দিলজান। মেদীপুরের পাশেই বাড়ি। গাড়োয়ানভাইয়ের নাম?
–জী, হারুন আলি। হারাই বলে ডাকো হারাই তার দিকে ব্যাকুল চোখে তাকায়। ফের বলে —কেমন দেখলেন, ভাইজান?
দিলজান একটুকরো পাথরকুচি কুড়িয়ে বলে—গরুটার গতিক ভাল না। রাত পেরোয় কিনা।
আঁতকে ওঠে হারাই। বোবায় ধরা গলায় প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে–বাঁচবে না?
—তাই মোনে হয়।
–সানকিভাঙার বদ্যি…
—আরে থোন ভাই পিরিমলার কথা শালো গোবদ্যি! ফাঁকির কারবার! দিলজান বাঁকা মুখে বুলতে থাকে। গাঁজাখোর শালো প্যাটের জ্বালায় গোবদ্যি সেজেছে। আমি যা দেখলাম ভাই, আপনার গরু বাঁচবে না। এক কলম লেখে দিতে বোলেন তাও দিবা
দিলজানের পকেটে কাগজকলম আছে। হারাই ধুলোয় আঙুলের দাগ টানে আর জুলজুলে চোখে তাকায়। কী বলবে ভেবে পায় না।
দিলজান বলে—এক কাজ করুন, ভাই আপনিও মোছলমান, আমিও মোছলমান। জাতভাই বলেই বুলছি।
খুব আগ্রহে হারাই বলে–কহেন! কহেন জী!
–বুলছি কী, গরুটা আমাকে দেনা দু পয়সা আপনার হোক, আমারও হোক।
হারাই দম আটকে বলে—জী?
দিলজান হাসে খুক খুক করো —গরুটা দেন আমাকে হালাল করি।
অমনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় হারাই। বুকফাটা চিৎকার করে বলে— ন্না! তারপর হাঁফাতে থাকে। তার নাকের ডগায়, চিবুকে, কপালে এই শীতেও ঘামের ফোঁটা চকচক করে। সে ফের। ধরা গলায় বলে কান্না! এবং মাথাটা জোরে দোলায়। সে ভূতের মতো অঙ্গভঙ্গী করে।
দিলজান হা হা করে হাসে–তিরিশ টাকা দাম পাবেন ভাই। দিলজানের নগদানগদি কারবার। আপনি জাতভাই, রাস্তার মধ্যে বিপদে পড়েছেন বুলেই বুলছি। আপনার গরু বাঁচবে না। এ দিলজান দেখে দেখে বুড়োতে চলল, ভাই রে। তামাম এলাকার লোক সেটা জানে।
হারাই মুখ নামিয়ে ঘাড় গোঁজ করে বলে—মাফ দিবেন, ভাইজান আপনি আমার কলজে কিনে লেন, দিবা ধনা হামার বড় কষ্টের ধোনা হামার বহু ধনাকে বেটার মতন পেলে বড় করেছে। সে ফের জোরে মাথা দোলায়।
—শেষ কথা। চল্লিশ টাকা। দ্যাখেন ভেবে।
হারাই দ্রুত হেরিকেন তুলে নেয়। হাঁটু দুমড়ে গাড়ির তলায় ধুরিতে আটকে দেয়া তারপর জোয়ালে যায়। মনাকে জুতে দিয়ে আগের মতো ধনার জায়গায় বুকে জোয়াল তোলে। পা বাড়ায়। গাড়ি গড়াতে থাকে। আবার চারু মাস্টারের বেহালা বেজে ওঠে করুণ সুরে।
দিলজান পাশে হাঁটে।–খুব ঠকলেন, ভাই। মোছলমান বলেই…
হারাই ভয়ঙ্কর গর্জন করে চেরা গলায়–হামার কলজে!
আর দিলজান অন্ধকার ফাটিয়ে হা হা হা হা হাসে আপনার কলজে হারাম, ভাইজানা আমি হালাল জিনিস কিনতে চেয়েছি। রাগ করবেন না। মাথাটা এটু ঠাণ্ডা করুন আপনার ‘ডাহিনালি গরুটা তো কিনতে চাইছি না আপনার ‘বাঁওয়লি’টা মরে যাবে। চল্লিশ টাকা!
হারাই মুখ ঘুরিয়ে রাগী চোখে তাকায় শুধু তারপর অস্পষ্ট হাঁকরানি দিয়ে জোয়াল টানে।
—দেখছেন! আর বেচারী হাঁটতে পারছে না। ওই…ওই দেখুন থুবড়ে পড়ল!
হ্যাঁ, ধনা বার বার হাঁটু মুড়ে টাল খাচ্ছে। শুকনো পীচে খটাখট আওয়াজ উঠছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে হারাই ফের বলে—ক্ষমা দিবেন হামাকো, আপনি আপনার ঘাঁটায় যান, হামি হামার ঘাঁটায় (রাস্তায়) হাঁটি।
দিলজান তবু সঙ্গ ছাড়ে না। পকেট থেকে নোট বের করে, আর সেই একই কথা কিন্তু মেদীপুর আর কতদূর? হা খোদা! হারাই যে বুড়ো হয়ে গেল, তবু পৌঁছতে পারল না মেদীপুরে! যত চলে, দূরে সরে যেতে থাকে মেদীপুর। পেটে টান বাজে। বত্রিশ নাড়িতে টান লাগে। আহা, গোজন্মের বড় কষ্ট, ধনা রে! দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠে বাঘড়ে গাড়োয়ানের। হেই বাপ! আর পারি। নে। হামি তো মানুষ বটি। হামি জানোয়ার লই। এই ভার টানার তাকত হামার নেই। আঃ! বড় তিয়াসে গলা শুখা। বুকের ভেতরটাও শুকিয়ে যাচ্ছে। জিভ হয়ে গেছে খড়ের গুছি। মেদীপুরে গিয়ে পানি খাব। ধনা তোকেও খাওয়াব। আর মনা, তুইও খাবি। আর এটু কষ্ট করি দুজনায়।
—শেষ কথা ভাইজান, পঞ্চাশা এই নেন।
দিলজান হারাইয়ের ফতুয়ার পকেটের দিকে হাতটা নিয়ে আসে। আর ফের হারাই গর্জন করে ওঠে—হামার কলজে বেরহম (নির্দয়)! পাষাণ! আপনার দেলে দয়া নাই! হারাই শ্বাস টেনে বলে—আপনি আজরাইল!