হারাই গাড়ি টানে আর চারু মাস্টারের বেহালা বাজতে থাকে।
ধীরে ফুটে ওঠে মাথার ওপর নক্ষত্রমালা। উত্তরের রাতচরা ডাকিনীর মাঠে মাঠে ঘেঁড়াখোড়া খড়নাড়া, মরা শামুক ও ঝিনুকের খোল আর শুকনো পাতার ওপর হাল্কা পা ফেলে হেঁটে আসো ভয়ে ও কষ্টে চেঁচিয়ে ওঠে দূরের শেয়ালা নক্ষত্রের তাপ নিতে নিতে হিম ডানা নেড়ে উড়ে যায় বুনো হাঁসের ঝাঁকা হারাই শ্বাস টেনে একবার মুখ তুলে দেখে নেয়া কখনও হাঁপাতে হাঁপাতে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে—আয় বাপ, জিরেন খেতে খেতে আয়। আর হারাইয়ের মনে কত কথা এখন। এ তো মাঘ মাস, বেটা ধনা! ডাকপুরুষের বচনে আছে, ‘আধা মাঘে কম্বল কাঁধো’ কিন্তুক ডাকপুরুষ যে ডাকপুরুষ, সেও কি জেনেছিল গোজন্মের কী কষ্ট? হুঁ, গোজন্মে বড় কষ্ট বাপা আজ খোদাতালা হামাকে সিটা জানান দিলো বড় কষ্ট, ধনা। এখন তো জাড় কমে এল। কিন্তুক আঘুন পোষের জাড়? হায় বাপ, বুঝি নাই। সেকথা এই মানবজন্মোতে ঠাউর করি নাই। এখন করনু গোজম্মের ঘাটে ঠেকে, ধনা, (আর মনা তুইও শোন) সব ঠাউরানু ক্রিমে ক্রিমে। এই দ্যাখ বাছা, আমি মানুষ। হামি তোর মতন জানোয়ার হয়ে গেনু!
দুঃখে হেসে ওঠে হারাই। শ্বাসপ্রশ্বাস মিশিয়ে হাসে। …হাসছিস না বেটা? জান ভরে হাস। তবে কথা কী, ভেবে দেখলে দুনিয়ার অনেক মানুষও তোদের মতন অবোলা জানোয়ার বইকি। ঠাউর করে দেখবি, তাদেরঘে পিঠে ওজনদার ছালা চাপানো আছে ধনা। তাদেরঘেও ছালা বহিতে হয়, বাপা, ঠাউর করে দ্যাখা হাসিস না। তাদেরঘে ভি কষ্ট। ঘাড়ে কালো দাগ পড়ে। গোস্ত দড়কচা পড়ে যায়। শাঁস (শ্বাস) ফেলতে হাঁপানি, পা ফেলতে জাংয়ে বেথা, পিছের ভার টেনে হাঁটো তাদেরঘে ভি মুনিব আছে। ঠাউর করে দ্যাখ।
হাঁ করে নিঃশ্বাস নেয় হারাই। ফের বলে গোজমে বড় যন্তন্না। আর তার এই অর্ধস্ফুট বাক্য নতুন এক প্রজ্ঞার মতো আবছা অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হতে হতে দূরের জনপদে ছড়িয়ে যায়। আর চাকায় চাকায় চারু মাস্টারের বেহালা বাজতে থাকে করুণ সুরো আকাশে মুখ তুলে। ভারবাহী গাড়োয়ান ফের সেই প্রজ্ঞা উচ্চারণ করে—গোজন্মে বড় যন্তন্না।
মেদীপুর চটি কি মুছে গেছে দুনিয়া থেকে? সানকিভাঙা থেকে বড়জোর দু ক্রোশ পথা অথচ এখনও সামনে হাঁ-করা অন্ধকার রাত। হারাই থমকে দাঁড়ায় বার বার আর কতদূর মেদীপুর? অবোধ জন্তুর চোখে তাকায় সে বুঝতে পারে না, কতকাল সে তিন বস্তা রাঢ়ী ধান টেনে আনছে। মনার সঙ্গে। ঠাওর হয় না কিছু যেন কত বছর মাস দিন রাত আর গ্রীষ্ম বর্ষা শীত কেটে গেল। গাড়ি টানতে টানতে হারাইয়ের কালো চুল দাড়ি কি সাদা হয়ে গেল। হা খোদা! এভাবে গাড়ির জোয়ালে আটকে থেকেই কি তার মউত হবে? ভয়ার্ত গাড়োয়ানের কানে ভেসে আসে যেন মৃত্যুদূত আজরাইলের ডানার শব্দ। সে বার বার আকাশ দেখো নক্ষত্রভরা আকাশের দিগন্তে এক ছবি দেখতে পায়। তার ছোট্ট বাড়ির সামনে ওই যে পাটকাঠির বেড়ার ধারে লম্ভ হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলেপুলের মা! আসবার সময় ধনা মনার পা ধুইয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে মেয়েটা বলেছিল—ভালয় ভালয় ফিরিয়ে আনিস মানুষটাকে। তোদের হাতে ওনাকে জিম্মা দিনু আর বাছারা, তোরাও যেন ভালয় ভালয় ফিরে আসিসা এমনি লম্ভ হাতে দাঁড়িয়ে পিতিক্ষে করব দোরগোড়ায়। হামারু নিদ হবে না, বেটা রে।
…বহু গে! হামি ভালয় ভালয় ফিরে এনু। এই দ্যাখ তোর ধনা, এ দ্যাখ তোর মনা। বড় গুণের বেটা তোর, বহু…হারাই হাসবো ধনাকে দেখিয়ে বলবে—বেটা বহুৎ কষ্ট দিয়েছিল বহুগো তোর বেটাটো বড় হারামজাদা। ভাল করে পা ধুইয়ে দে। ক্যাশ দিয়ে ভি মুছিয়ে দো …হুঁ, তা তো দেবেই মুছিয়ে। বাছুর-বয়সে ধনা যেদিন ঘরে এল, সেদিন, বহু কেশ দিয়ে চার পা মুছিয়ে দিয়েছিল। পদ্মার জল মাটির কলসীতে ভরা। অবেলায় এনে রেখেছে মায়েঝিয়ে। সেই জলে অজু করে নমাজ পড়েছে কলিমুদ্দির মা। মঙ্গল কামনা করেছে। আর সেই পদ্মার জল মাটির জল মাটির বেদনায় ভরে দোরগোড়ায় পায়ের কাছে রেখে রোজ শেষরাতে অবদি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে মেয়েটা। গোহিলে (গোয়ালঘরে) ভুষির জাবনা ভেজানো থাকবে।
হঠাৎ চমকায় হারাই। বাঁ পাশে ধনার পেছনে এক মূর্তি ভেসে উঠেছে। হারাই ভয় পাওয়া গলায় বলে—কে, কে গে? সাড়া নাই শব্দ নাই! কে আসে গে?
লোকটা লম্বা পা ফেলে পাশে এসে একটু হাসে।–বাড়ি কোথা গাড়োয়ান-ভাইয়ের?
সন্দিগ্ধ গলায় হারাই জবাব দেয়—বাঘড়ী, ভাইজান।
–আসসালামু আলাইকুম।
মুহূর্তে হারাই আশ্বস্ত। কিন্তু কষ্টে জবাব দেয়—ওয়া আলাইকুম আসসালাম।
—গরুটার কী হল? বেমার নাকি?
কথা বলার লোক পেয়ে হারাই দাঁড়িয়ে পড়ে। ভাইজানা হঠাৎ ওবেলা থেকে ছ্যারানি। বড় মুশকিলে পড়নু সানকিভাঙায় বদ্যি দাওয়াই দিয়েছে। তাই ভাবনু…মানুষের সামনে পড়ে একটু লজ্জাও পেয়েছে হারাই। গরুর মতো গাড়িটানার লজ্জা। সে অপ্রস্তুত হাসে।
লোকটা বলে–লণ্ঠন নাই সঙ্গে? এমন করে আঁধার ভেঙে যাচ্ছ দেখি! রোঁদের পুলিস ধরবে যে!
সঙ্গে সঙ্গে হারাই গাড়ির জোয়াল থেকে ছিটকে বেরোয়া এক পাশে টেনে মনার কাঁধ থেকে জোয়াল নামায়। তারপর—এ হে হে, কথাটো মোনেই ছিল না, আমার মাথায় বজ্জাঘাত ভাই রে, বলে হাঁটু গেড়ে গাড়ির তলা থেকে হেরিকেনটা আনো কোঁচড় থেকে দেশলাই বের করে জ্বালো হাওয়া বেড়েছে, নিবে যায়। তখন লোকটা নিজের পকেট থেকে দেশলাই বের করে বলে—এ জন্যেই তোমাদের বলে বাঘড়ে! কই দেখি, জ্বেলে দিই।