বকের ঠ্যাং ফেলে পিরিমল হাড়ি চলে গেল। আলোর রঙ ধূসরতরা হারাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর বালতির জল আঁজলা করে তুলে ধনাকে খাওয়াবার চেষ্টা করে। গড়িয়ে যায়। ফের দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে ওঠো তার একটু পরেই আচমকা অর্জুনের ডালে প্যাঁচা চ্যাঁচায়—ক্রাঁও ক্রাঁও ক্র্যাঁও! শরীর ভারি হয়ে যায় হারাইয়েরা বিড় বিড় করে দেওয়া আওড়ায়। মাঝে মাঝে একটা করে মোটরগাড়ি উজ্জ্বল আলো ফেলে চলে যায়। সেই আলোয় গরু দুটোর চোখ থেকে নীল রঙ ঠিকরে বেরোয়, আর হারাই হিমে ও ত্রাসে ঠকঠক করে কাঁপে …
হারাই কাঁপে, কারণ সামনে এক ভয়ের রাত হাঁ করেছে দেখতে পায়। তার লকলকে কালো জিভ থেকে হিমের লালা গড়িয়ে পড়ছে খোদাতালার দুনিয়ায়, আর বিকেল ও সন্ধ্যা দু-দুবার নমাজ না-পড়ার গোনাহ হারাইয়ের কপালে আঁকা পুণ্যের দাগটাকে যেন ঘষে তুলে ফেলছে। হারাই বার বার চমকায়। ধূসর আলোয় শেষ পাখির ঝাঁক মাঠে শস্যদানা খুঁটে খেয়ে ফিরে আসে অর্জুনের ডালে। তারা চাপা স্বরে কী বলাবলি করে। চারপাশে চক্রান্ত চলতে থাকে সামনে ওই ভয়ের রাতের মুখের হাঁ বড় হতে থাকো মাকড়সার জালে আটকে পড়া পোকার মতো নিঃসাড় হয়ে জুলজুলে চোখে বসে থাকে বাঘড়ীদেশের গাড়োয়ানা।
ফের সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইসমিলের শুকনো ডালটা দেখো পশ্চিমের লালচে একটুখানি ছটা, আর কী হল বলে আগ বাড়িয়ে দেখতে আসা হঠকারী এক নক্ষত্রের ক্ষীণ ছুঁচলো আলোয় বাকুলছাড়া ডালটা এখনও আবছা দেখা যায়। কালুদিয়াড়ের ইসমিল কি হারাইয়ের দশা দেখে মিটিমিটি হাসছে?…তা হারাই অনেক ইসমিল দেখেছে। দিনের রোদে দূরের পথ ভাঙতে অবোলা জানোয়ারের কষ্ট বলেই বাঘড়ে গাড়োয়ান রাতচরা। দিনে জিরেন, রাতে গড়িয়ে চলা। কত রকম ভূত আর জিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কত ইসমিল গাড়ির সঙ্গ ধরে পাশে, সামনে বা পিছু পিছু হেঁটে আসে। কখনও মানুষের রূপ, কখনও শেয়াল কী বেড়াল। আবার কখনও পাখি হয়ে কানের পাশে ডানা ঝাপটে যায়। একবার তো দোলাইয়ের বাঁ কানের ডগা রক্তারক্তি করে দিয়েছিল। গাড়োয়ানকে কান-মাথা ঢেকে গামছা জড়িয়ে রাখতে হয়। আনাড়ী দোলাই তা জানত না। খুব শিক্ষে হয়েছিল ছোকরার।
আর ভয় রাহাজানিরা তাই সঙ্গে হেতেরপাতি রাখতে হয়। দল বেঁধে যাতায়াত করতে হয়। সামনের গাড়ির বলদজোড়া খুব ‘ছিক্কিত’ আর মদৰ্মান’—অর্থাৎ কিনা বলবান হওয়া চাই তার গাড়োয়ানও হবে দলের সেরা অভিজ্ঞ আর সাহসী মানুষ আবার পেছনের গাড়ির বলদ ও গাড়োয়ানও তেমনি হওয়া দরকার। এর নাম গাড়োয়ানী বিদ্যো অনেক ঠেকে ঠকে ও দেখেশুনে এই বিদ্যের ধার বাড়ে তবে কথা কী, হারাই চিরাচরিত সেই মরসুমী সওদাগরীতে এবার আসে নি। ফাগুন মাসে চারু মাস্টারের বিটির বিভা। তাই দোলাই বলেছিল, যত কুমড়া লাগে দিব। যত কলাই লাগে দিবা হারাই ভাইয়ের কথা রাখতে এসেছিল।
আসন্ন অন্ধকার ভয় দেখানো রাতের সামনে বসে মোহ্যমান বাঘড়ে গাড়োয়ান এতক্ষণে ফোঁস ফোঁস করে নাক ঝেড়ে একটু শোক কিংবা অসহায়তা প্রকাশ করল। মেদীপুর চটি সামনে ক্রোশ দুই পথ গাড়িটা সেখানে নিয়ে যেতেই হবে। এই নির্জন ভয়ঙ্কর জায়গায় আর থাকা উচিত নয়। তিন বস্তা ধান নয়, তিন বস্তা সোনা। রাঢ়ী ভাতের সাদা ঝকঝকে স্বাদু সুগন্ধময় কণা বউছেলেমেয়েদের খিলখিল করে খুশীতে হেসে ওঠার মতো দেখতে পেল হারাই মনের কোণায়। এই শাহদানার প্রত্যাশায় এখন বাঘড়ীর কত দুঃখী হাভেতে ছেলেমেয়ে ঘরে ঘরে অপেক্ষা করে আছে। হারাই চঞ্চল হল এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর রুগণ গরুটার গায়ে হাত রাখল স্নেহে। —বাপ ধনা রে!
হারাই ধনার পিঠের কাঁপন টের পায়। কষ্ট করে এটু গা তোল বাছা! বদ্যির ওষুধ খেয়েছিস, আর ভয় কিসের? ওরে বেটা, না না ভাবছিস তোকে গাড়ি টানাব ফির (ফের)? আমি কি লিয়া মানুষ? সোনা হামার, ওঠ দিকিনি!
হারাই আরও আদর ও সান্তনায় জিভ চুকচুক করে বলে বুঝি রে বুঝি! সেই ছুটো থেকে মাগমরদে পেলেছি, তু হামারঘে বেটা। হামারঘে কলিমদ্দি ছলিমদ্দি আসিরদ্দি যেমন ব্যাটা, তোরা ধনা-মনাও হামারঘে দুই ব্যাটা ওঠ বাপ। হুই মেদীপুর! হুই দ্যাখ!
সে ধনার মুখটা তুলে ধরে। ধনা জোরে মাথাটা নাড়ো শিঙের গুঁতো লাগে হারাইয়ের হাঁটুর কাছে। অমনি ক্ষেপে ওঠে বাঘড়ে গাড়োয়ানা গর্জায়—জোভিয়ে! জবাই করব! কলজে খাব শালার ব্যাটা শালার! কেমন বেইমান দেখছ?
সে পেটের খোঁদলে পাচনের গুঁতো মারে বার বার। তখন ধনা সামনে দুই পা বাড়িয়ে মাটি আঁকড়ায় এবং ওঠার চেষ্টা করো হারাই গোবরমাখা লেজটা টেনে পেছন দিকটা তোলে। মুখে গাড়োয়ানী বুলি বলতে থাকে ইরররর হেট হেট হেট! লে লে লে লে! হুদ্দে হুদ্দে হুদে! হে হে হে হেঃ!
ধনা দাঁড়িয়েছে। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে হারাই। তারপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তাকে গাড়ির পেছনে নিয়ে যায়। বেঁধে দেয় পাছোটের বাঁশের সঙ্গে। তারপর মনাকে ডাইনের জোয়ালে জুতে দিয়ে নিজে বাঁ দিকের জোয়াল ধরে দু হাতে বুকের সঙ্গে জোয়ালটা চেপে গর্জন করে টানে সো চাকা গড়ায়।
পীচে উঠে একটু দম নেয়। তারপর পা বাড়ায়। গাড়ির পিছনে বাঁধা রোগা বলদটা এখন ভারমুক্ত। দড়িতে টান পড়ে আর নড়বড় পা ফেলে সামনে রাস্তায় চাকার সেই পুরনো শব্দ ওঠে ধারাবাহিক—গভীর এবং চাপা গম্ভীর শব্দ, হৃৎপিণ্ডের শব্দের মতো আর তেল-শুকনো ধুরি থেকে এতক্ষণে কেমন একটা রুগণ কোঁ কোঁ শব্দ শোনা যায়। হারাই শোনে চারু মাস্টারের বেহালা বাজছে।