চারু মাস্টার বেহালা বাজানো কোমল হাত তুলে নাড়েনা আহুদী মেয়ে দৌড়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে হারাই চাচার গাড়ি যদূর যায়, দেখতে থাকে। শূন্য মাঠের বুকে শেষ মাঘের বিকেলে ধুলো উড়িয়ে যেতে যেতে গাড়িটা পাকা সড়কে পৌঁছুলে সে বলে—ও বাবা! হারাইচাচাকে নেমন্তন্ন করলে না? তুমি ভারি ভুলো মন। …
একটা মাঠ পেরিয়ে পুকুরপাড়ে ক’ঘর লোকের বাসা পাকা রাস্তার ধারে একলা এক লম্বা নির্জন গাছ। দোনামোনা করে গাড়ি বাঁধে হারাই। সূর্য পাটে বসতে আর বিঘৎখানেক দূরত্ব। গাড়িতে তিন বস্তা ধান আছে। হারাই দৌড়ে যেতে যেতে বার বার পিছু ফেরে। সামনের মেয়েটাকে বলে—বিটি, ইখানে গোবদ্যি কে আছে রে?
মেয়েটা ঝোপের আড়ালে কম্ম করতে এসে তলপেটে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিচ্ছে। একটু বিরক্ত হয়ে বলে—হুই দেখ না। পিরিমলখুড়ো দাঁড়িয়ে আছে।
চেহারায় সেটা মালুম বটে। বেঁটেখাটো লিকলিকে কালো গোবদ্যির জটা আর ডগডগে সিঁদুর হু হু জ্বলছে। রুক্ষু লাল চোখে কিসের ঘোর। এক শুকনো গাছের ডগায় দাঁড়কাক ডাকলে হাতের সাপমুখো বাঁকাচোরা লাঠিটা তুলে নাকি স্বরে বলল—যা, যা! ইখনে কী? পুবে যা, পছিতে যা। উত্তরে দখিণে যা! ইভেনে কী?
হারাই কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে—বিষম বিপদ। চণ্ডীতলার চারু মাস্টের বুললেন…
–বুঝিছি। শিসটানা, না বাঘতড়পা?মুসকোনা ছ্যারানি?
–ছ্যারানি।
—ডাইনালি, না বাঁওয়ালি?
—বাঁওয়ালি।
—মরেছে!…বলে পিরিমল হাড়ি ঘরে ঢোকে। একটু পরে বেরিয়ে এসে বলে—তা মাস্টেরের খাতির, পাঁচ সিকে লাগবে।
হারাই চোখ কপালে তোলে অত তো নাই বদ্যিমশাই। আনা বারো আছে। দয়া করুন, বড় বিপদে পড়ে এনু।
পিরিমল হাড়ি বকের ঠ্যাঙ বাড়িয়ে হাজার কথা বলে তোমাদের বাঘড়ে গাড়োয়ানদের ওই এক দোষ বাপু নেয্য পয়সাটা দেবে না। খালি মাস্টেরের খাতির! মাস্টের কি আমার অন্নদাতা, না মুনিব? ভারি তো ক্যাঁই কোঁ কোঁ বাজনা শিখেছেন। আমি কি মেয়েমানুষ যে মজিছি? যেতে যেতে তিন পুরুষের নামধাম, গরুদুটোর জীবনচরিত জেরা করে জেনে নেয় পিরিমল বদ্যিা তারপর অর্জুনতলায় গিয়েই লাফিয়ে ওঠো —এঃ হে হে হে হে! করিছিস কী! ওরে ফুটুকচাঁদ! ওরে বাঘড়ে ভূত! এইখেনে গাড়ি বেঁধিছিস? হায় হায় হায় হায়! আবাগীর বেটা করিছে কী গো!
সূর্য পাটে বসেছে। দুপাশে প্রসারিত শস্যশূন্য মাঠে বুনো পায়রার ডানার রঙ ঘনিয়ে আসছে —এই পৃথিবীটাকে মনে হয় মুখ গুঁজে থাকা বুনো পায়রার মতো ঝিম। উত্তরের হাওয়ার দাপট একটু কমেছে এই দিনশেষে শেষ মাঘের হিম চোঁয়াতে শুরু হয়েছে আকাশ থেকে অনেক দূরে আলের আড়ালে দাঁড়িয়ে একবার একটা শেয়াল ডেকেই চুপ করে গেল। ধরা গলায় হারাই বলে—ইখানে গাড়ি বাঁধলে কী দোষ, বদ্যিমশাই?
পিরিমল হাড়ি গাছের শেকড়ের বাঁকাচোরা লাঠিটা তুলে বলে–হুই দেখছিস একটা শুকনো ছালছাড়া ডাল। দেখতে পাচ্ছিস?
ভয়ে ভয়ে দেখে নিয়ে হারাই বলে–হুঁ।
–কালুদিয়াড় চিনিস কুথা?
—সে তো ভৈরব নদীর পাড় ভগরথপুরের ধারে।
–কালুদিয়াড়ের ইসমিলকে চিনতিস?
–না, বদ্যিমশাই।
—ইসমিল ইভেনে গাড়ি রেখে কী করেছিল জানিস?
–না, বদ্যিমশাই।
—আপ্তহত্যে।
হারাই শিউরে উঠে তাকায় শুধু মন কেন খালি কু গায়? ধনা ফের শুয়ে পড়েছে। একরাশ ছ্যারানিতে এরই মধ্যে অনেকটা জায়গা নোংরা। কটু গন্ধ ছোটো মনা ডান দিকের জোয়াল থেকে এক ঠ্যাং বাড়িয়ে ধনার কপাল চাটছে। আহা, অবোলা জন্তু। একসঙ্গে ওঠাবসা গতায়াত খাওয়া-দাওয়া। একের কষ্ট অন্যে টের পায় বইকি।
পিরিমল ফের বলে—আপ্তহত্যা। ডালটা সেই তাতে শুকিয়ে যেয়েছে। তা যাক গে, না জেনে যা করিছিস, করিছিস! কই চাট্টি খ্যাড় দে।
চারু মাস্টারের দেওয়া তড়পা থেকে এক গোছা খড় আনে হারাই। বদ্যি খড়গুলো দু দিকে মুড়ে তার মধ্যে একটা শেকড়-বাকড় ঢোকায়। তারপর ধনার মাথায় বুলিয়ে বলে—ভাললামোন। বাপ রে! যাদু রে! গোজন্মের বড় কষ্ট, তা কি জানি না? ইবারে খেয়ে ফেলল। দিকিনি! চিবিয়ে চিবিয়ে খাও। আলন্দে জাওর কাটো। একটুখানি জিরিয়ে লাও। তাপরে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও…ওরে, বালটিন আছে সঙ্গে?
হারাই ব্যস্ত হয়ে বলে—ডোলচি আছে।
পিরিমল খিক খিক করে হাসে।–তোরা বুলিচ ডোলচি, আমরা বুলি বালটিনা একই কথা। যা বাপ, আঘাটার জল নিয়ে আয়। এক লিঃশ্বেসে ভরবি। সাবাধান!
বালতি নিয়ে হারাই দৌড়ে যায়। দম আটকে আঘাটার জল ভরে অর্জুনতলায় এসে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলে হাঁফায়। পিরিমল বদ্যি খড়ের নুড়োটা ধনার মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ধনা আস্তে আস্তে চোয়াল নাড়ছে। তারপর পিরিমল কোমর থেকে একটা শুকনো লতানে ঘাস বের করে। সেটা ধনার মাথা থেকে লেজ অবধি বারকতক বোলায়। তারপর বলে— জল কই?
বালতির সামনে বসে সে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ে। ফু দেয় জলে। শেষে বলে—ইবারে একটুখানি খাইয়ে দে। বাকি জলটা কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর খাওয়াবি বাপ। সাবোধান, রাতটো কিছু খেতে দিবি নো সকালে শুকনো দুব্বোর সঙ্গে এই ওষুধটা খাওয়াবি। তারপর পারিস তো একটুকুন ভাতের ফ্যান দিসা হুঁ, পয়সাটা দে চলে যাই। এক জায়গায় ভূতে ধরা রুগী দেখতে যেতে হবে।
কাঠের হাতে বারো আনা পয়সা এগিয়ে দেয় হারাই। পিরিমল উঠে দাঁড়িয়ে বলে—জল দে মুখো আর শোন বাপ, ইভেনে থাকিস নে। শালা ইসমিল জ্বালাবে। কাজটা ভাল করিস নাই। বরঞ্চ মেদীপুরের বাজারে গিয়ে জিরেন দিসা রাতটুকু।