নিমতলায় দাঁড়িয়ে ভাইয়ের কথা মনে পড়ে হারাইয়ের। দোলাই থাকলে এবার ফের বাড়ি ঢুকত গলা খাঁকারি দিয়ে। মাস্টারের মেয়েকে ডেকে বলত—ও বহিন, বহিন গে! ইবার একখিলি পান দ্যাও, খাই।
হারাই পান খায় না। বিড়িতামাক খায় না। সন্ধ্যায় মসজিদে গিয়ে ধর্মকথা শোন। দুটো কাঁঠাল আর তিনটে আম গাছ আছে। সতের কাঠা জুঁই আছে। দুটো বলদ গরু আছে। একটা গাড়ি আছে। শীতের শেষে দূরের এই রাঢ়ে গেরস্থরা যখন ধান ঠেঙিয়ে মড়াইতে তোলে, হারাই তখন চনমন করে ওঠো সতের কাঠা ক্ষেতের খন্দকী সবজি, গাছের ফল-মাকড় বোঝাই করে সন্ধ্যা থেকে গাড়ির সব বাঁধন আঁটো করেছে বিকেলো ধুরিতে রেডির তেল মাখানো হয়ে গেছে। প্রথম পহর শেষ হলে আদাড়ে শেয়াল ডাকে। লম্ভ হাতে পাটকাঠির বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে তার বউ আর ঘুম-ঘুম চোখে ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকটি মুখে প্রত্যাশা ঝকমক করো বাপ ফিরে এলে রাঢ়ী মিঠা ধানের ভাত খেতে পাবো যে-ভাত পালায়-পরবে খায় মোন্নাজীরা, মিয়াসায়েবরা, বাবুমশাইরা। সেই ভাত-সাদা ঝকঝকে মিহি স্বাদু শাহদানা’। মোন্নাজী বলে, শাহদানা। শ্রেষ্ঠ দানা বা শস্যা রাঢ়ে শাহদানার মরশুম এলে সারা বাঘড়ী অঞ্চলে শিহরণ ঘটে যায়। ভাগীরথী-ভৈরবী-পদ্মার পলিতে ভরাট নরম মাটির এই সমতল দেশে সাড়া পড়ে যায়। খদ-ফলমূল গরু-মোষের গাড়িতে বোঝাই করে দলে দলে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে সোনার রাঢ়ের দিকে এগিয়ে চলো চাকায় চাকায় সদ্য তেলমাখানো ধুরির শব্দহীন চাপা আবেগ তখন থরথর করো ভাগীরথী পেরিয়ে কতক দূরে কেউ এক মুঠো মাটি তুলে নিয়ে পরখ করে। এ মাটির রঙ সোনালী এই মাটি শাহদানা ফলায়। সাদা, ঝকঝকে, মিহি চিকন স্বাদু ভাত। ভাপের গন্ধে মন ভরে যায়। ভুখ মিছিলের মুসাফির মাটির গন্ধ শোঁকে। যেন সেই ভাতের গন্ধ পায়।
হারাই সেই ‘মুসাফির’ নয়। মাঙতে আসে না রামুলুকে। খন্দ ফলমূল সবজির বদলে ধান মেপে নেয় তারাজুতে। এই শেষ মাঘে সে এসেছে মরা ভাইয়ের কথা রাখতে কিন্তু চারু মাস্টার বড় দয়ালু ভালমানুষ। তিন বস্তা ধান দিয়েছেনা বলদের জন্যে দু তড়পা খড়ও দিয়েছেন। দু রাতের রাস্তা। আর বাঘড়ীর এসব মানুষজনের সঙ্গে রাঢ়ী মানুষের বংশ-পরম্পরা কুটুম্বিতো হারাইয়ের বাপও মরশুমে এলে চারু মাস্টারকে দেখা না দিয়ে যেত না। ফি বছর আম-কাঁটাল দিয়ে যেত সেধো চারুবাবুর মা বুড়োকে জোর করে এক পুটুলি মুড়ি গুছিয়ে দিতেন। বুড়িমা আর বেঁচে নেই। থাকলে হারাইকে একখানা নতুন গামছাও দিতেন বইকি।
বেলা হু হু করে পড়ে এল। শেষ শীতের রুক্ষ ক্ষয়াখবুটে রাঢ়ী গাছপালা আর শুখা শুখা ন্যাড়াটে ঘরবাড়ির গায়ে রোদের রঙ তেলতেলে দেখাচ্ছে। বস্তা তিনটে বয়ে এনে গাড়িতে চাপায় এবং বাঁধাছাদা করে হারাই। চারু মাস্টারের মেয়েটা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হাসো ও চাচা, তোমাদের দেশে আম পাকলে আনবে তো? আসবে তো, চাচা?
—আসব বিটি, আসবা…হারাই ডাইনের বলদটাকে চাকা থেকে খুলে এনে জোয়ালে দড়ি আটকায়। বাঁ দিকেরটা খুলতে গিয়ে ফের বলে তো ও গে ভালমানুষের বিটি! ফাগুন মাসে তুমার বিভা। চাচাকে বিভা খেতে তো ডাকলে না! হেই মা, আমি কি তুমারঘে পর?
লজ্জায় রাঙা হয়ে বিটি দরজার আড়ালে ঢোকে। তার বাবা নিমতলায় বলেন—ডাকলেও কি আসতে পারবে, হারাই?আর তো মোটে দিন দশেক আছে। পারলে অবশ্যি এসো।
হারাই বাঁওয়ালি বলদটাকে ওঠাতে ব্যস্ত। ইররর-হেট হেট হেট! হিই! দেখছ, দেখছ?ঃঃ! সে লেজ ধরে টানাটানি করে। গর্জায় বার বার দুশমন! জোভিয়াঃ (জবাইযোগ্য)! জবাই করব
বুলছি, হুঁ! উঠল? উঠল এখনও? তারপর একটু ঝুঁকে আদুরে স্বরে হামার বাপথোন রে! সোনা। রে! মানিক রে! এটুকুন কষ্ট কর বাছা! সানকিভাঙা পজ্জন্ত চুক চুক করে গেলেই খালাস। ইররর হেট হেট! ওরে, আর জ্বালাসনে বাপ! বাড়ি যাব—আমরা বাড়ি যাব।
এই রকম আদর, ছেলেভুলোনো কত কথা, কখনও কসাই ডাকার শাসানি, জবাই করার হুমকি—ফের গায়ে হাত বুলিয়ে নেমকহারামী করিস নে সোনা! এ্যাটুকুন থেকে পুষেপেলে এত বড়টা করনু তার এই ফল রে?
চারু মাস্টার হো হো করে হাসেনা –ওরে উতুরে ভূত! ও হারাই! বরং এক কাজ করা গাড়ি থাকা তুই সানকিভাঙা চলে যা পিরিমল বদ্যিকে ডেকে নিয়ে আয়। দেখছিস না, ছ্যারানি হয়েছে গরুটার?
তা তো দেখতেই পাচ্ছে। খড়ের গোছা মুখে ধরা। চোখের কোণায় কালি কালো ধারা আঁকা। হাড়ের সারা ঠেলে উঠেছে রাতারাতি হারাই উঠে দাঁড়ায়—বরাবর একটুকুন বদমাইসিও আছে, মাস্টেরবাবু। বুঝলেন? হ্যাঁকাৎপনাও আছে। ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়াল তো দাঁড়াল। তবে পা ফেললে থামানো যায় না। ব্যাটার এই বড় গুণ। তখন পংখিরাজ ঘোড়া।
ঘুরে সূর্যটা দেখে নিয়ে ফের সে লেজে মোচড় দেয় এবং পাঁজরে পাচনের গুতো মারো চারু মাস্টারকে অবাক করে গরুটা হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ায়। বস্তায় হাতের গোবর মুছে হারাই একটু
হেসে বলে-দেখলেন?
—তা তো দেখলাম। কিন্তু পিরিমলকে একবার দেখিয়ে নিয়ে যাস বাপু।
হারাই জোতা পরায়। অবোলা জানোয়ারা বুঝতে পেরেছে এবার ঘরে ফেরার সময়। রোগা পা-টেনে-চলা বলদের এখন যেন পিঠে ডানা গজায়। সব গাড়োয়ানই তা টের পায়। হারাই গাঁয়ের পথে ধুলো উড়িয়ে যেতে যেতে খুশিতে চ্যাঁচায়হামার পংখিরাজের বাচ্চারে! হামার। এরুপ্লেলেন রে! হেই মাস্টেরবাবু, ফাগুন মাসে বিটির বিভায় যদি আসি, হামার ধনাকে পাঁচ তড়পা খ্যাড় দিতে হবে—এ—এ–!