কী কথা?
আমি আর আসব না।
জানালার রড শক্ত করে ধরে বললাম, না। তোমাকে আসতেই হবে—আমি যতদিন বেঁচে আছি। আমার রাতগুলো তোমার জন্যেই রেখেছি, আর দিনগুলোকে শ্রুতির জন্য।
সে একটু হাসল। তুমি বড়লোক মানুষ। তোমার কত খেয়াল!
না, না। খেয়াল নয়। এমনটা হয়ে গেছে–তুমি বুঝতে চেষ্টা কর লক্ষ্মীটি! চিরকাল আমার বরাতটাই এরকম। কিছু নিয়ন্ত্রণে থাকে না আমার। আরও দেখ, আমার সব বাস্তব আর কল্পনাও আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। ওরা দুটো দিকে, মধ্যিখানে আমি। টাগ অফ ওয়ারের নিষ্ঠুর খেলা।
ওসব কথা আমার মাথায় ঢোকে না, আমি যাই!
শোন, শোন! একটা কথা বলে যাও।
কী?
তুমি কেন আর আসবে না? শ্রুতির জন্যই কি?
শ্রুতির জীবন আমার মত নষ্ট হয়ে যাক, তা চাইনে। আমি তার দিদি।
শোন, শ্রুতির বদলে তোমাকেই চাই।
এমনি করে একদিন আমার বদলে শ্রুতিকে চেয়েছিলে, মনে পড়ে? কী? চুপ করে গেলে যে?
আমি অনুতপ্ত। ক্ষমা কর।
দেখ আমি যেখানে আছি, সেখানে ক্ষমা বা অনুতাপ বলে কোন কথা নেই। তোমার মনে পড়ে? ওই খাটে আমি শুয়েছিলাম। আমার শ্বাসকষ্ট। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। তখন তুমি আর শ্রুতি পাশের ঘরে ছিলে। একটু পরে শ্রুতি এল। ওকে দেখেই চমকে উঠলাম। তার শরীরে তোমার ছাপ পড়েছিল। জলের গ্লাস তার হাতে কাঁপছিল।
তুমি ধাক্কা মেরে গ্লাসটা ফেলে দিলে। শব্দ শুনে দৌড়ে এলাম…
জানালায় কী করছ?
শ্রুতির চমকে ওঠা প্রশ্নে আমিও খুব চমকে উঠলাম। সে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে বিছানায় উঠে বসল। তীব্র দৃষ্টিতে আমরা দিকে তাকিয়ে বলল, আবার তুমি জেগে আছ?
ঘুম আসছে না। দেখ, অদ্ভুত জ্যোৎস্না উঠেছে।
শ্রুতি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে বলল, তুমি চাও, আমিও দিদির মত মরে যাই, তাই না?
আঃ কী বলছ শ্রুতি!
তুমি বুঝি ভাবছ আমি কিছু টের পাই না? শ্রাবন্তীর দিকে এবার তোমার চোখ পড়েছে।
ছিঃ! চুপ কর।
শ্রুতি প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। না—চুপ করব না। তুমি চাইছ, আমিও দিদির মত সুইসাইড করি, আর তুমি শ্রাবন্তীকে বিয়ে কর।
তি! চুপ কর। কী বলছ তুমি? স্মৃতি সুইসাইড করেনি।
করেছিল। আমি জানি। শ্রুতি নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বরে বলল। ক্যাপসুলটা খেয়ে রিঅ্যাকশান হচ্ছিল, ডাক্তার সেটা বন্ধ করতে বলেছিলেন। দিদির বালিশের তলায় কৌটোটা দেখেছিলাম। কৌটোটা খালি ছিল।
আশ্চর্য। তুমি বলনি! কেন বলনি শ্রুতি?
তুমি কষ্ট পাবে ভেবে। শ্রুতি মুখ নামিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকল।
তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে সে শুয়ে পড়ল। টেবিলল্যাম্প নিভিয়ে দিল। জানলার বাইরে বাগানের দিকে জ্যোৎস্নার ভেতর কুয়াশার মত কী একটা দাঁড়িয়ে আছে। স্মৃতিই কি? শ্রুতিকে ডাকলাম, শ্রুতি, শোন!
কী?
শ্রাবন্তীর কথা তোমার মাথায় এল কেন? তার সঙ্গে তো আমার দেখাও হয়। তেমন কিছু আলাপও নেই। তাছাড়া সে তো তোমার কাছেও আসে না।
বাইরে কী হয় তুমিই জান। সারাদিন কোথায় থাক, কী কর, আমি কি দেখতে যাই?
শ্রুতি, ফুড রিলিফের কাজে আমাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হয় আজকাল। অন্যকিছুতে মন দেবার সময় কোথায়?
তুমি লিডার মানুষ। তোমার মনে কত দয়া। এমনি করে সেবার ফ্লাডের সময় তুমি আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলে। তখন বুঝিনি, এই বাড়িটা তোমার একটা ফাঁদ।
ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, ঠিক আছে। ওদের চলে যেতে বলব। ওদের এরিয়া থেকে মারে জল নেমে গেছে। কিন্তু আমার অবাক লাগছে শ্রুতি! নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। কাল রাতে তুমি বললে, স্মৃতিকে ভুলতে পারিনি। আজ রতে বলছ, শ্রাবন্তীর জন্য…
কথা কেড়ে শ্রুতি বলল, তাই ভেবেছিলাম। পরে মনে হয়েছিল, যে মরে গেছে–গর পেছনে কেন তুমি ছুটবে? যে বেঁচে আছে রক্তমাংসের শরীরে, তার পেছনে ছোটাই স্বাভাবিক। নয়? বল তুমি।
কিন্তু তুমি তো আছ! তুমি তো জীবিত।
আমি বাসি হয়ে গেছি। দিদিও তোমার কাছে বাসি হয়ে গিয়েছিল। তাই তুমি আমার পেছনে ছুটেছিলে। কিন্তু জেনে রাখ, আমি দিদির মত বোকা নই।
তর্ক করে লাভ নেই। ফেমিনিন লজিক। আমি চুপ করে থাকলাম। শ্রুতিও চুপ করে থাকল। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। প্রতি আমাকে বাধা দিল না।
বাগানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কতক্ষণ। স্মৃতি কি আর কোনদিন আসবে না কথা বলতে? জ্যোৎস্নায় হেমন্তের গাঢ় কুয়াশা জড়ানো। ঘুম জড়ানো গলায় খুব গভীর থেকে পোকামাকড় গান গাইছে। সামনে শীত—তখন ওরা আরও গভীরে দীর্ঘ ঘুমের দিকে যাবে। কোথায় সেই প্রাকৃতিক অভ্যন্তর-জঠরের উষ্ণতা যেখানে বাইরের পৃথিবীর হিমকে পৌঁছতে দেয় না? সেখানে কি স্মৃতিও ঘুমোতে চলে গেল জীবজগতের অবচেতনায়?
আমার কষ্টটা বাড়ছিল। স্মৃতিকে আমি ভালবাসতাম। শ্রুতিকেও হয়তো ভালবাসি—চেষ্টা করি। পেরে উঠি না। খালি মনে হয়, শ্রুতি আমার জন্য নয়, আমার সংসারের জন্য। একটি প্রয়োজনীয় ফিলার শ্রুতি। আর স্মৃতি ছিল আমার জন্য—আমার সংসারের বাইরে একটি নিজস্বতার প্রতীক। স্মৃতি, কেন গেলে?
যাই নি। সে ফিসফিস করে বলল। এই তো আছি!
কিন্তু কোথায় আছ? আগের মত কাছে আসছ না কেন?
পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছি ক্রমশ। নিজেকে কুড়িয়ে জড়ো করা যাচ্ছে না।
মনে হল, চারদিকে ঘাস, গাছপালা, পোকামাকড়, শিশির, কৃষ্ণপক্ষের জ্যোৎস্না আর কুয়াশার ভেতর থেকে স্মৃতির শ্বাসপ্রশ্বাস জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। সে বলছে, আমি আছি। আমি আছি।