তাকে বলি, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে।
সে বলে, আমি তো এরকমই।
না। তুমি এরকম ছিলে না।
সে একটু হাসে। তা ঠিক। ছিলাম না।
কেমন ছিলে সে তো মনে পড়ে তোমার, নাকি পড়ে না?
বোকা। মনে না পড়লে এলাম কেন?
তাহলে তুমি নিজেকে দেখাও। আমারও তো তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে।
তুমি ভয় পাবে।
তোমাকে আমি ভয় পাব না স্মৃতি! তুমি আমারই অপরাংশ হয়েছিলে একসময়।
একটু পরে সে বলে, পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে।
তাহলে থাক।
বরং চলো আমরা বাগানে যাই।…
আমরা বাগানে গিয়ে বসে থাকি। কথা বলি। পুরনো সব কথা…অতীত থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে। দুঃখের কথা। সুখের কথা। কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই ষষ্ঠীদাসের ডাক শুনতে পাই। সে লণ্ঠন হাতে আমাকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে। আসে। সে বড় ধূর্ত মানুষ। সব টের পায়। আমাকে বকাবকি করে। বলে, ঘুম হয় না তো ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন? এমনি করে হিমে বসে থাকলে যে উন্টে অসুখে পড়বে।…
হতচ্ছাড়া ষষ্ঠীদাসের দৌরাত্ম্যে অবশেষে বাগানে গিয়ে কথা বলা ছাড়তে হল। কিন্তু বুঝতে পারলাম, কেন স্মৃতি ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে চাইত না। শ্রুতিকে ও ঈর্ষা করত। ঘুমন্ত শ্রুতির পাশে গিয়ে দাঁড়ালে আমার খুব ভয় হত। বলতাম, ওখানে কী করছ? এখানে এস। শ্রুতি জেগে যেতে পারে।
জাগলেও তো আমাকে দেখতে পাবে না।
কে জানে। মেয়েরা হয়তো সব টের পায়।
সে হাসত। হুঁ, পায়ই তো! তুমি যখন শ্রুতিকে আদর কর, দূর থেকে টের পাই। মনে হয়, আমার যদি শরীর থাকত!
ওকে মেরে ফেলতে তো?
হুঁ।
এখন পার না?
না।…একটু পরে বলল ফের, আমি আর কিছু পারি না। শুধু যাওয়া আসা ছাড়া। মনে হল, ও কাঁদছে। বললাম, ওকে ঈর্ষা কোর না। ও তোমারই সহোদরা।
শোনো!
বলো।
তুমি কাকে বেশি ভালবাস এখন…শ্রুতিকে না আমাকে?
দুজনকেই।
মিথ্যা! আমি তোমার চারঘরের সংসার ঘুরে দেখেছি, এখন যা-যা যেমন হয়ে আছে, আমার সময়ে তেমন কিছুই ছিল না। ওই ড্রেসিং টেবিলটা পর্যন্ত নতুন! আর শ্রুতির কত শাড়ি! কত বিদেশি সেন্ট! কত…।
শ্ৰতি একটু বিলাসী প্রকৃতির মেয়ে। আর তুমি জান, তুমি ছিলে সাদাসিধে। সাজতে ভালবাসতে না। টাকাকড়ি খরচ করতে দিতে না। মনে পড়ে, সেবার তোমার জন্য অত সুন্দর একখানা কাঞ্জিভরম কিনে আনলাম! তুমি শ্রুতিকে পরতে দিলে। আর একবার…।
হঠাৎ থেমে গেলাম। টের পেলাম। ও নেই। চলে গেছে। এখনকার মত মাথা ভাঙলেও আর ফিরে আসবে না। কোথায় যায় ও? জীবজগতের সীমানা পেরিয়ে প্রকৃতির কোন গভীরতর স্তরে গিয়ে বসে থাকে ও? আমি যদি ওকে অনুসরণ করে যেতে পারতাম সেখানে!…
একরাতে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি থামল না। মধ্যরাতে একটু কমল মাত্র। তারপর তার আসার সংকেত শুনতে পেলাম বাগানের দিকে। দরজা খুলে দিলাম। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।
সেই মুহূর্তে শ্রুতি জেগে গেল। চমকে ওঠা গলায় বলল, কোথায় গেলে? এই তো! অন্ধকারে দরজা খুলে কোথায় যাচ্ছ?
সে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিল। ভারি হাতে দরজা আটকে দিয়ে বললাম, বৃষ্টি দেখতে যাচ্ছিলাম বারান্দায়।
শ্রুতি একটু চুপ করে থাকার পর বলল, জানলা থেকে দেখা যায় না?
ছাঁট আসছে যে!
তোমার কী হয়েছে?
কই, কিছু না।
আমার ধারণা, তুমি সারারাত জেগে থাক।
যাঃ! কে বলল?
আমি জান। তুমি…তোমার শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে না আমার পাশে? শ্রুতি স্বাসপ্রশ্বাস মিশিয়ে বলল, কতবার হাত বাড়িয়ে তোমাকে খুঁজি পাই না।
আশ্চর্য! আমি তো তোমার পাশেই থাকি!
শ্রুতি বালিশে মুখ গুঁজে বলল, কোথায় থাক তুমিই জান।
ওর কাছে এসে পিঠে হাত রেখে বললাম, ঘুমোও।
তুমি?
আমার ঘুম পাচ্ছে না। আর বৃষ্টিটা কী সুন্দর—শোন!
আমি জানি, কেন ঘুম হয় না তোমার। দিদির কথা মনে পড়ে তো?
হঠাৎ ওকথা কেন শ্রুতি?
হাসতে হাসতে বললাম, ছিঃ! যে মরে গেছে তাকে ঈর্ষা করতে আছে?
কে মরে গেছে? দিদি মরে নি। দিব্যি বেঁচে আছে। পাগল! কী সব বলছ শ্রুতি?
শ্রুতি ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে বলল, বেঁচে নেই—তোমার মনে? ষষ্ঠীদা বলে, তুমি রাতে বাগানে গিয়ে বসে থাক—কেন আমি যেতে দিই এমন করে? কেন বাগানে যাও তুমি? বল!
ঘুম আসে না।
এত ভাবলে ঘুম তো আসবেই না। শ্রুতি আবার পাশ ফিরে শুল। ফের আস্তে করে বলল, আরও অনেক কথা জানি। বলব না।
কী জানে, সে কিছুতেই বলল না। কিছুক্ষণ সাধাসাধি করে ছেড়ে দিলাম। মনে হচ্ছিল শ্রুতি কেঁদে ফেলবে—অথবা এক নেপথ্যের কান্না ওকে ভিজিয়ে দিচ্ছে ভেতর থেকে। অবশ্য খুব শক্ত মেয়ে সে, জানি। স্মৃতির একেবারে উল্টো। সে প্রচণ্ড সাহসী। বেপরোয়া। স্পষ্টভাষী মেয়ে। কিন্তু স্মৃতির মতো জেদি নয়।
পরের রাতে আমার উৎকণ্ঠা ছিল স্মৃতির আসা না টের পেয়ে যায় সে! এ রাতে বৃষ্টি ছিল না। নরম চেহারার একটুকরো চাঁদ ছিল বাগানের মাথায়। পোকামাকড় ডাকছিল বৃষ্টির স্মৃতি নিয়ে। ফিকে জ্যোৎস্নায় ভিজে গাছপালা আর ঘাসের গন্ধের সঙ্গে মিশে রাতের ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল ঘরে। ভাবছিলাম, কাল রাতে ফিরে গেছে অমন বাধা পেয়ে, আজ কি করে আসবে স্মৃতি?
এল—কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নয়। জানালার ওধারে দাঁড়িয়ে বলল, এসেছি।
এ রাতে কোন প্রাকৃতিক সংকেত শুনলাম না। কোন পূর্বাভাষ না। মল্লিকদের কুকুরটাও বুঝি অগাধ ঘুমে লীন। বললাম, ভেতরে আসছ না কেন?
একটা কথা বলতে এলাম শুধু।