মৌলবি বলেন—বলেন কী! এ তো বেআইনী! তা ছাড়া এখন জমিদার কোথা?
—আইন-বেআইনের কথা লয়, মৌলবি সাহেব। বদর হাজি বলেন, জমিদারের সাথে প্রোজার বাপ-ব্যাটার সম্পর্ক ছিল। বাপ-দাদো জবান দিয়ে গেছে তেনার কাছে। সেটাই হল গে বড় কথা। তা ছাড়া এই ভট্টমাটিতে পেরায় সব লোকই পরোজি’—গোরুর গোশতো খায় না। আপনি লতুন এসেছেন। বিয়ে-সাদির খানা হলে দেখবেন। বলবে—ভাইসকল! কে কে ‘পরোজি আছ হাত তোলো। দেখবেন একশোটা হাত খাড়া হবে আসমানে।
বদর হাজি হা হা করে হাসেনা মৌলবি সায়েব গম্ভীর মুখে মাথা নাড়েন—এটা বে-শরা। ঠিক না।
হাজি বলেন–তো কী আর করা! মাঝে মাঝে সেই মেদীপুরে হালাল হয়। লুকিয়ে-চুরিয়ে কেউ কিনে এনে খায়। আমার ভাগ্নেব্যাটা একেবারে গো-খাদ (খাদক)। আজ হাটবার ছিল। দিলজান একটা হালাল করেছে শুনে নিয়ে এসেছিল। তা দেখেছি, ভালই হল। আপনি আছেন। আর এই আমার মেহমান বেডা আছে। মেহমানেরও খাতির হল।
হারাই টুকরোটা মুখে পুরেছিল। আচমকা নড়ে ওঠে তারপর তক্তপোশের নীচে থুথু করে। ফেলে দেয়।
হতবাক হাজি বলেন—ও বাপ! তুইও পারোজি নাকি? তা বুলিস নাই ক্যানে?তা ছি ছি ছি!
হারাই মুখে হাত চেপে নেমে যায় আসন ছেড়ো ছিটকে বাইরে যায়। বাইরে তার ওয়াক তোলার শব্দা খাওয়া ফেলে বদর হাজি দৌড়ে যান।
গিয়ে শোনেন, যেন বমিতোলার ওয়াক নয়। তাঁর আধবুড়ো বাঘড়ে মেহমান বুকে হাত দিয়ে বারান্দার ধারে বসে হা হা করে বুক ফেটে কাঁদছে। হাজি বলেন—ও বাপ! তোর কী হল? শরীল খারাপ?
হারাই ভাঙা গলায় বলে হেই হাজিসাব! হামাকে হারাম খাওয়ালেন!
অমনি ভেতর থেকে মৌলবি বেরিয়ে এসে গর্জন করেন—এ্যাই কমবখত! এ্যাই বে-শরা উল্লুক! তোর মুখ, না পায়খানা? ও কী বলছিস? হালালকে হারাম বলছিস! তওবা তওবা! নাউজুবিল্লাহ!
হারাই কথা কানে নেয় না। বারান্দা থেকে নীচে নেমে রাতের আবহমণ্ডল এফেঁড় ওফেঁড়ি করে বলে—হামাকে হামারই বেটার গোশতো খাওয়ালেন! হেই হাজিসাব! হামার ভেতরটা জ্বলে খাক হয়ে গেল গে! এক-পদ্মার পানিতেও ই আগুন নিভবে না গো!
বদর হাজি হাসতে হাসতে বলেন—বাঘড়ে ভূত কাঁহেকা! মৌলবি বলেন—জাহান্নামী কাঁহেকা! হাদিসে লেখা আছে হালালকে হারাম, আর হারামকে হালাল করে যে, তার পিঠে চল্লিশ কোড়া (কশা) মারো! বাঘড়ে গাড়োয়ানের দল লণ্ঠনের আলোয় ভাত খেতে খেতে এদিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। কিছু বুঝতে পারে না। দলিজঘরের নীচে আবছা আলো-অন্ধকারে একটা লোক জবাইকরা প্রাণীর মতো ধড়ফড় করছে। … পশ্চিম দেশ থেকে চলেছে এই পথ পূবের দেশে, সোনালী মাটির এলাকা থেকে সাদা গুঁড়ো দুধের মতো নরম মাটির এলাকায়। কালো পীচে ঢাকা এই আঁকাবাঁকা পথ চলেছে ভাগীরথী পেরিয়ে, ভৈরব পেরিয়ে পদ্মাসীমান্তের দিকে। আজ রাতে এই পথে চারু মাস্টারের বেহালা বাজছে করুণ সুরে। চারু মাস্টারের বিটির বিভা হবে ফাগুন মাসে দোলাই বলেছিল সেই বিভার সব কুমড়ো আর কলাই দেবো দোলাই এখন পদ্মার পাড়ে গাবগাছের তলায় মাটির ভেতরে শুয়ে আছে। তার বড়ভাই হারাই ফিরে আসছে সেই কুমড়া আর কলাই দিয়ে নিয়ে আসছে কিছু রাঢ়ী ধান আর চারু মাস্টারের বেহালার সুর। সে দেখছে, নক্ষত্ৰভরা আকাশের ঈশাণ কোণে এক ছবি। দূরের গাঁয়ে পাটকাঠির বেড়ার ধারে লম্বা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কলিমদ্দিরের মা। হারাইয়ের বহু। তার পায়ের কাছে মাটির বদনায় পদ্মার জল। ধনা-মনার পা ধুয়ে দেবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। স্পষ্ট দেখা যায়।
ফাঁদ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
রাত অনেক হলে বাগানের দিক থেকে ক্রাঁও ক্রাঁও করে একটা পেঁচা ডেকে ওঠে। মল্লিকদের কুকুরটা সন্দিগ্ধভাবে দু-একবার ডেকেই সপ্রশ্ন চুপ করে যায়। আমি জানি, এইবার তার আসার সময় হয়েছে।
আমাদের বাড়িটা বেশ বড়। লোকজন তত কিছু নেই। ওপরে-নিচে চারটে করে আটটা ঘর। নিচের দুটো ঘরে থাকেন দূর সম্পর্কের আত্মীয় আর তাদের মেয়ে শ্রাবন্তী। একটা ঘরে পুরনো আসবাবের আবর্জনা। বাকিটাতে বাড়ির সাবেক আমলের চাকর ষষ্ঠীদাস। তার বয়সও প্রায় সত্তর হয়ে এল। সারারাত খকখক করে কাশে আর একটু শব্দ হলেই ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, যাঃ! যাঃ! আমি জানি, কাকে সে এমন করে তাড়াতে চায়।
ওপরের চারটে ঘরে আমার জীবনযাত্রা। আমার আর শ্রুতির। শ্রুতি বড় ঘুমকাতুরে। সে কিছু টের পায় না। এই যে আমি কাকে এত রাতে দরজা খুলে দিই, কার সঙ্গে কথা বলি, কিছু না। আমার আদরের ভেতর শ্রুতি কখন গভীর ঘুমে এলিয়ে যায়। তার শরীরের শ্বাসপ্রশ্বাস শুনতে শুনতে হঠাৎ চমক ভাঙে প্রাকৃতিক সংকেতের মতো পেঁচার চিৎকার। তারপর বাগানের দিকে শনশন করে ওঠে বাতাস। গাছপালা দুলতে থাকে। পুরনো জানলাটা খটখট করে শব্দ করে। তারপর সিঁড়িতে যেন পায়ের শব্দ। সে আসছে উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠি। সিঁড়িতে যেন পায়ের শব্দ। সে ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।
দরজা খুলে আমি একটু সরে দাঁড়াই। টের পাই তার ঘরে ঢোকা তার শরীরের গন্ধ। গন্ধটা ছেঁড়া ঘাসের মত কিংবা ভিজে মাটির মত, অথবা পাখির বাসার মত ঈষৎ ঝঝাল, সঠিক বলা কঠিন, কারণ তার গন্ধটা যেন খুবই প্রাকৃতিক। হয়তো সে প্রকৃতির খুব ভেতর দিকে চলে গেছে বলেই। জীবজগতের অবচেনায় এই গন্ধ থাকে কি? বুঝতে পারি না। তার অশরীরী শরীরের কোন গন্ধ থাকার কথা নয়। তাকে প্রশ্ন করলে সে বলে তাই বুঝি? জানি না তো।