সেই জীপটাই কর্নেল সরকারের জন্যে পাঠানো হয়েছিল এবং আটকে পড়েছিল। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার, দারুণ খামখেয়ালিই বলব–কারণ পথে বালিয়াড়িতে দুতিন ঘণ্টা কাটিয়ে এসেছেন। তার গলায় ঝুলছে ছোট্ট বাইনোকুলার। ওই দিয়ে তিনি এক বিরল জাতের পাখি আবিষ্কার করে আটকে পড়েন। কর্নেল কি অর্নিথোলিজিস্ট? নো, নেভার মাই ইয়ং ফ্রেণ্ডস! বরং ন্যাচারালিস্ট বলতে পারেন–অফ কোর্স, দ্যাটস এ হবি। বার্ডওয়াচিং!
সৌখিন গোয়েন্দা নাকি ভদ্রলোক। বিহ্বল বলেছিলেন। কিন্তু মহিন্দর আর ভারত না ফেরা অব্দি বাংলোর বারান্দায় আমাদের নিয়ে, আশ্চর্য, নির্বিকার গল্পগুজব আর ফাঁকে ফাঁকে ওটা সেটা প্রশ্নও করেছিলেন। কে কী করি, কোথায় থাকি, কখন পৌঁছেছি জেনেও নিলেন। তখন হতভাগিনী রাত্রি হ্যাঁলুসিনেশানের, ঘোরে, মাঝে মাঝে ভুল বকতে বকতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কর্নেল কী কায়দায় ওকে ব্রোমাইড জাতীয় ওষুধ খাইয়ে দিলেন–আমরা লক্ষ্য করেছি। কর্নেল বলেছেন– ও ঘুমোক। সকালে দেখা যাবে কী করা যায় ওকে নিয়ে। তাই রাত্রি নিস্তব্ধ এবং গাঢ় ঘুমে ডুবেছে তার বিছানায়।
সোফাগুলো টেনে আমরা বারান্দায় বের করে বসেছিলুম। কর্নেলই কথা বলছিলেন আসলে। আমরা তিনজন ফ্রিজের ঠাণ্ডায় রাখা তিনটি কালো বোতলের মতো। অন্তত নিজের কথা বলতে পারি। বিহ্বল মজুমদারের মৃত্যুটা যদি খুনই হয়, তাহলে–মাই গুডনেস! আমরা তিনজন–আমরা তিনজনই….।
আর ভাবা যায় না। যতবারই এগোচ্ছি, সামনে দেখছি–একটা অতল গভীর খাদ। চুল শক্ত হয়ে উঠছে। হা–ওই খাদটা মারাত্মক। মানে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ দায়ী কি না–তা নির্ভর করছে জানালার নিচের লোকটার ওপর অর্থাৎ রাত্রির ওপর। রাত্রি আমাদের এখন কম্পাস। কিন্তু কী ছিল সব ইচ্ছে আর কল্পনা–চাঁদ, ঝাউবন, বালিয়াড়ি, নির্জনতা, মদ্যপান! আর কী ঘটে গেল নিয়তির অনিবার্তার মতো! আড়চোখে লনে খোলামেলায় ঘাসে বিহ্বল মজুমদারের মড়াটা দেখছি জ্যোৎস্নায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। অবিশ্বাস্য! এও রাত্রির মতো একটা হ্যালুসিনেশান।
এমন সময় অমু একটু কেসে বলল, কর্নেল, আপনি তো গোয়েন্দা?
বেখাপ্পা হাসলেন কর্নেল।…নাহ্। এও একটা হবি। তা যা বলছিলুম, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনও লোককে হত্যা করার সঠিক সময় খুনী বেছে নেয় কখন জানেন? যখন সেই লোকটি অবচেতন ভাবে তোক কিংবা সচেতন ভাবে–নৈতিক দুর্বল অবস্থায় থাকে। তখনই আঘাত হানলে কাজ সফল হয়। সেজন্যেই দেখবেন– সমাজের ওই স্তরের ওই ধরনের লোক অধিকাংশ সময়ে রক্ষিতা বা প্রেমিকার কাছে। থাকার সময় খুন হয়। বাট হিয়ার ইজ এ কোয়াইট ডিফারেন্ট কেস।…..
অমু সোজা হয়ে বলল, মিঃ মজুমদারের খুনী আমাদের তিনজনের একজন। তাই তো কর্ণেল সরকার? ইট অ্যাপিয়ার্স সো। কিন্তু জানালার নিচে সত্যি সত্যি যদি কাকেও দেখে থাকেন রাত্রি?
কর্নেল হাত তুলে বললেন, সেকথা পরে হবে। অফিসারদের আসতে দিন।
অমু কঁপা গলায় বলে উঠল, দেখুন কর্নেল, আমার দৃঢ় ধারণা–মিঃ মজুমদারের গ্লাসে নিশ্চয় কেউ বিষ মিশিয়েছিল–সে বাইরের লোক। আর মিসেস মজুমদারের ওটা হ্যালুসিনেশান নয়। সত্যি কেউ এসেছিল–যখন আমরা ওঁর চিৎকার শুনে দৌড়ে ঘরে আসি তখন সে
ওর কথাটা যুক্তিসিদ্ধ মনে হলো। কেড়ে নিয়ে বললুম–সেটাই খুব সম্ভব। আমরা কী উদ্দেশ্যে মিঃ মজুমদারকে খুন করব? তাই না অমু? এই তো সব বালির ঢিবি, ঝোপঝাঁপ রয়েছে। কেউ নিশ্চয় লুকিয়ে থাকতে পারে।
অমু ঘোঁত ঘোঁত করে বলল, আলবত পারে। আমরা মিঃ মজুমদারের শত্রু। ছিলুম নাবন্ধু। আর খুন করতে হলেই বা বোকার মতো এভাবে করব কেন বলুন। কর্নেল? এ তো সুইসাইডাল ব্যাপার। মোডাস অপারেণ্ডিটা.. ।
কর্নেল ফের হাত তুলে বললেন, প্লীজ, প্লীজ। এবং সেই সময় ফের রাত্রির কণ্ঠস্বর শোনা গেল–দিগুর কবিতাটি আবৃত্তি করেছে। কিন্তু দুটো লাইন বারবার ফিরে আসছে তখনকার মতো : উজ্জ্বলতাগুলি নিল কঠিন শামুক/গোরস্থানে সংহত কফিনে…। আমার কান গরম হয়ে উঠছে ক্রমশ। ওই কবিতাটি কেন লিখল দিগু? তখন সত্যি কি নিয়তি তার কল্পনাকে ভর করেছিল? না আকস্মিক যোগাযোগ?
কর্নেল শুনে বললেন, দেখি কী ব্যাপার? বলে দ্রুত উঠে ঘরে ঢুকলেন।
আমরা পরস্পরের দিকে তাকালুম। কিন্তু কিছু বললুম– না। তিন জোড়া নীল জ্বলজ্বলে চোখ শুধু। আমার গা শিউরে উঠল বারবার। জানালার নিচে একটা লোক–দিগুর মতো পোশাক!
রাত্রি বলেছিল। কিন্তু দিগু তো আমাদের সঙ্গেই ছিল তখন। রাত্রি ভুল করেছে, মস্ত ভুল করেছে।
কর্নেল ফিরে এসে বললেন, ঘুমের ঘোরে বলছে। কবিতাটি ভারি অদ্ভুত তো?
দিগন্ত বলল, ওটা আমার লেখা।
তাই বুঝি? আইডিয়াটা বেশ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। ঝাউবনের শব্দ শুনেছেন তো? সেই রকম কীসব ইমেজ আসে। বলে কর্নেল দূরের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন–ওরা আসছে এতক্ষণে। কিপ কোয়ায়েট। ভয় পাবার কিছু নেই।…
একটু পরেই দুটো জীপ এসে গেল। তারপর বালির ওপর টর্চের আলো পড়ল ঝলকে ঝলকে। একটা জ্বলন্ত হ্যাঁজাকও বের করা হচ্ছিল গাড়ির ভিতর থেকে। দেখলুম, সাত-আটজন পুলিশ অফিসার আর রাইফেলধারী কনেস্টবল আর গলায় স্টেথো-ঝোলানো ডাক্তার এগিয়ে আসছে। এতক্ষণে প্রচণ্ড ভয়ে সিঁটিয়ে গেলুম। … সেই উজ্জ্বল আলোয় স্লেটে আঁকা খড়ির স্কেচের মতো দেখাল আমাদের।