এসব শুনতে শুনতে নিয়ামত রসুল পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। পেছনে তাকায় না। জানতে চায় না আফরোজা ফিরে যাচ্ছে, নাকি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে? ও পলিউশন ভরা বাতাস টেনে অনুভব করে ওর ভেতরটা বেশ ফ্রেশ লাগছে। কোথাও কোনো দুনীরি বোধ নেই।
পরদিন অফিস থেকে ফেরার পরেও দেখতে পায় আগের দিনের মতো টেবিলে একগাদা খাবার। ও সেদিকে এক পলক তাকিয়ে বেডরুমে ঢোকে। আফরোজা ঘরেই ছিলো। ওকে দেখে ড্রেসিং টেবিলের ওপর তে নতুন কেনা পারফিউমটা তুলে নিয়ে বলে, তোমার জন্য কিনেছি। সকালে দিলু-মিলু এলো। ওরা কেনাকাটা করতে গুলশান যাবে, তাই আমাকে নিতে এসেছিলো। আমি গেলাম। মিলুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে পারফিউমটা কিনেছি। চার হাজার টাকা নিয়েছে। আর একটু ভালো কেনার ইচ্ছে ছিলো। টাকার জন্য পারলাম না। দেখো তো তোমার পছন্দ হয়েছে কি না?
-আমি এসব চিনি না।
–দেখোই না, দেখতে দেখতে চিনবে।
নিয়ামত রসুল আফরোজার চকচকে মুখের দিকে তাকায়। আশ্চর্য, কোনো কিছু ওকে আহত করে না। ও ক্রমাগত জালটা ফেলেই যাচ্ছে, তারপর একসময় ওকে টেনে তুলবে। ওর কৌশল নিয়ামত রসুলকে মুগ্ধ করে।
—কি হলো, তাকিয়ে আছ যে?
ইয়ে, মানে, একটা জিনিস জানতে ইচ্ছে করছে।
–কি?
–তোমার পূর্বপুরুষের কেউ কি জাল ফেলে মাছ ধরতো?
–মানে? আঁতকে ওঠে আফরোজা।
—মানে খুব সোজা। তেমন কেউ কি ছিলো যে নিপুণ জেলে, যার জালে ভরে উঠতো অজস্র রূপালি মাছ।
—এসব কি বলছো তুমি?
—হ্যাঁ, এটাও একটা দারুণ দক্ষতার কাজ, সবাই পারে না। কিভাবে জাল ফেলতে হবে বোঝে না। তুমি ভীষণ ভালো বোঝো আফরোজা।
–তুমি আমাকে অপমান করছে। বিয়ের পর থেকেই দেখছি আমার জন্য তোমার কোনো ভালোবাসা নেই। নিশ্চয়ই তোমার প্রেম ছিলো, তুমি সে প্রেমে ব্যর্থ। হয়েছে বলেই আমার সঙ্গে এমন আচরণ করছে।
—প্রেম? হো-হহা করে হাসে নিয়ামত রসুল।
–হাসবে না, হাসবে না বলছি। বলতে বলতে আফরোজা পারফিউমের শিশিটা ছুঁড়ে ফেলে। ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বলে, এরপর তোমার কাছে একটা দামি শাড়ি চাইলে বলবে, আমার পূর্বপুরুষের কেউ তাঁতি ছিলো কি না।
–না, সেটা বলবো না।
–বলবে না?
–হ্যাঁ,বলব না। কারণ তাঁতিরা শাড়ি বানায়, কিন্তু পড়ে না। ওদের কৌশলের দরকার হয় না।
বলতে বলতে নিয়ামত রসুল বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। দরজা বন্ধ করার আগে শুনতে পায় আফরোজা কাদছে। ঘাম-জলের মাখামাখির মতো ও কি বেঁচে থাকার অন্য কোনো মাখামাখি বের করবে? না কি এভাবেই আফরোজা কৌশল জানে, ও ঝগড়া করে না। অনবরত নিজের ইচ্ছেগুলোর কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু কতদিন বলবে? পরবর্তী কি দাঁড়াবে? ও সাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবনা এগোয় না।
বাথরুম থেকে বের হলে দেখতে পায় আফরোজা চোখের জল মুছে ফেলেছে। টেবিলে বসে পাঁপড় ভাজা খাচ্ছে। ওকে দেখে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, চা খাবে?
-আসছি।
নিয়ামত রসুল চুল আঁচড়ে, জামা গায়ে দিয়ে টেবিলে আসে। একট টুকরো পাঁপিড় তুলে নেয়। আফরোজা নিজের প্লেটে কাবাব নিয়েছে। ও হয়তো একটি একটি করে সব খাবে। নিয়ামত রসুল পাঁপড় খেয়ে চায়ের কাপটা টেনে নেয়। আফরোজা মুখ নিচু করে বলে, বিয়ের ছয় মাস হয়ে গেলো, কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা দাঁড়ালো না।
–কারণ, শুরুতেই তুমি সম্পর্কের মধ্যে দুর্নীতি ঢুকিয়েছো। বলেছো, উপরি পাওনার জন্য তুমি আমাকে পছন্দ করেছো? শুধুই আমাকে নয়।
–তোমাকে নিয়েই ওটা আমার বাস্তব কথা। যা তুমি করতে পারো, তা করবে কেন?
—সেটা ভালো না মন্দ তা বিচার করতে হবে না?
—আমিতো বিচার করেছি। সেটা অবশ্যই ভালো। ভালোভাবে বাঁচতে হলে টাকার দরকার। আমি তোমাকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে চাই।
—জানতে চাও নি আমার আয় আছে কি না?
—ভালো জীবনের জন্য সবার আয় থাকে।
—তুমি যেটাকে ভালো বলছে, সেটাকে আমি ভালো বলতে পারছি না। সেটা দুর্নীতি।
নিয়ামত রসুল টেবিলের ওপর ঠক্ করে কাপটা রেখে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। আফরোজা কিছু বলে না। কাবাব শেষ করে গাজরের হালুয়া প্লেটে নিয়েছে। নিয়ামত রসুল ড্রইংরুমে বসে সকালে পড়া কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরে। শুনতে পায় আফরোজা কাজের মেয়েটার সঙ্গে চিৎকার করছে। নিয়ামত রসুলের মনে। হয় ও এখন নিজের ভেতরে ক্রোধ এবং যাবতীয় শব্দ ছুঁড়ে ফেলছে। ছুঁড়ে ফেলা ওর কৌশল। ওভাবে প্রতিপক্ষকে দমন করা যায় না। নিয়ামত রসুল নিজের মনে হাসে। হাসতে হাসতে ছাদের দিকে তাকায় আশ্চর্য, দুটো টিকটিকি ওখানে সঙ্গমরত। নিয়ামত রসুল দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। আবার তাকায়। একই দৃশ্য আর নেই। ওদের জায়গা বদল হয়েছে, নিজেদের অবস্থান বদল হয়েছে। ওরা আগের জায়গা থেকে পুব দিকে সরে গেছে। ওরা অন্য ভঙ্গিতে যৌনসুখ উপভোগ করছে। দৃশ্যটি দেখতে ওর ভালো লাগছে এবং ও কাগজের আড়ালে মুখ রেখে দৃশ্যটি দেখে পুলকিত হতে থাকে। হঠাৎ ওর মনে হয় আজ রাতে কি মাদি টিকটিকিটির পেটে ডিম হবে। তারপর বাচ্চা। না, ও দু’হাতে কাগজটা খামচে ধরে। মাথাটা হেলিয়ে দেয় সোফার পিঠে। বিড়বিড় করে বলে, না কোনো বাচ্চা নয়।
রাতে আফরোজা ঠাণ্ডা স্বরে বলে, এতদিন তুমি আমাকে পিল খেতে বলেছ, আমি খেয়েছি। এখন আর খাবো না। আমি বাচ্চা চাই।