নিয়ামত রসুল বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। বড় বোনের চোদ্দ বছরের ছোট। বাবা মায়ের মাঝে বেশ কয়েকটি বাচ্চা হয়েছিলো, বাঁচে নি। ও বড় হওয়ার আগেই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। প্রায় পিতৃতুল্য দুলাভাইয়ের প্রস্তাবটিতে ওর আছে আদেশের মতোই ছিলো প্রায়। বোগাস, এসব ভাবার কোনো মানেই হয় না। ও খুব একা একা বড় হয়েছে এটাই এখন মূল কথা। কথাটা হলো ওর একাকিত্ব। একা একা আপন মনে বড় হওয়া এজন্যই কি আফরোজার সঙ্গ মাঝে মাঝে ভালো লাগে না?
—কি হলো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? চা খাবে না? আজ তোমার জন্য একগাদা নাস্তা বানিয়েছি।
একগাদা?
—তাতো করবোই। শোন, আমি কিন্তু অল্প টাকায় সংসার চালাতে পারবো না। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।
আফরোজার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ও সোজা বেডরুমে যায়। জামা গায়ে দেয়। চুল আঁচড়ায়। ডাইনিং টেবিলে এসে দাঁড়িয়ে বলে, দু’জনের জন্য এত খাবার! আমি তো শুধু চা খাবো।
—তো, এত কিছু কার জন্য বানিয়েছি?
আফরোজার কন্ঠে ক্রোধ।
–নিয়ে খাও। আমি দিতে পারবো না।
আফরোজা চেয়ারের ওপর পা উঠিয়ে হাঁটুতে মুখ গোঁজে। নিয়ামত রসুল পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলে, আমার সামর্থ্যের বাইরে কোনো কিছু আমি পছন্দ করি না।
আফরোজা ফোঁস করে উঠে চায়ের পটটা এক ধাক্কায় টেবিল থেকে ফেলে দেয়। সেটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে মেঝেতে গড়ায় চায়ের লিকার। নিয়ামত রসুলের বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে। ও চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় আসে। কপালে ঘাম জমে। এ ধরণের আচরণের সঙ্গে ও অভ্যস্ত নয়। ও বুঝতে পারে একটু পরে ওর শরীর থেকে কটুগন্ধ বের হবে। ও চা খেতে পারে না। চায়ের কাপটা বারান্দার কোণায় রেখে দিয়ে ও বাইরে চলে আসে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। বেশ স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। নিয়ামত রসুল প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। এখন আরও ঘামছে না। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে বলে আফরোজা দেখতে পায় নি। আফরোজা কি ওকে খুঁজছে? ও কি ওকে খোঁজার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে? নিয়ামত রসুল ফাঁক জয়াগায় দাঁড়িয়ে পড়ে পেছন ফিরে তাকাতে পারে না। দেখতে পায় শরীফ আসছে। ও পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। অনেক দিনের পরিচয়। ও বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শরীফ এসে ওর ঘাড়ে হাত রাখলে ও চমকে ওঠে। মনে হয় যেন, আফরোজা ওর ঘাড় খামচে ধরে বলছে, পালাচ্ছে কোথায়?
শরীফ অবাক হয়ে বলে, কি রে কি হয়েছে? তোকে ঠিক এ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসরের মতো দেখাচ্ছে। চুপ করে আছিস যে? কি হয়েছে। কিছু একটা তো ভাবছিস। ভাবনাটা কি?
—ভাবনা?
নিয়ামত রসুল শরীফের মুখের দিকে তাকায়। দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে। শরীফের চোখের মণিটা মনে হয় সবুজ। ভুরু জোড়া কালো নয়।
–কি দেখছিস।
—তুই কি আজ নিজেকে দেখেছিস শরীফ?
–না, দেখা হয় নি।
—দেখলে বুঝতি তুই আর আগের শরীফ নেই।
—বোগাস। পুরনো কথা বলছিস। এসব বলে বিদ্যা ফলানো যাবে না। কি হয়েছে বল?
—তুই জিজ্ঞেস কর আমি কি আজ নিজেকে দেখেছি?
—আমার বোঝা হয়ে গেছে, দেখেছিস এবং বুঝতে পেরেছিস যে তুই আর আগের নিয়ামত নেই।
–এখন কি করবো?
—কি আর করবি? বাড়ি যায় আর বউয়ের পা ধরে মাপ চেয়ে নে।
—কেন? মাপ চাইবো কেন?
—ভুলটা তো তোরই।
কথাটা বলে শরীফ ওর পাশ কাটিয়ে হনহন করে চলে যায়। নিয়ামত রসুল রাস্তার পাশের রেনট্রি গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থোকে। আশ্চর্য, ও ভেবেছিলো আফরোজার কথাটা ওকে কি বলা যায়, নাকি বলা উচিত হবে? সেই বিষয়টি শরীফ জানে। কেমন করে? কেন করে ওর চারপাশের মানুষের এমন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে। ওর নেই কেন? নিয়ামত দু’হাত বুকের ওপর রেখে উত্তেজনা দমন করে চায়। পারে না। ওর হাঁটু কাঁপে। ও প্রাণপণে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে নিজেকে সিঁটিয়ে রাখে। দেখতে পায় আফরোজা আসছে। আফরোজা একদম ওর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। নিয়ামত রসুল দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে পারে না, সেটা আফরোজার চোখের ওপরই রাখতে হয়। আফরোজা গড়গড় করে কথা বলতে থাকে, কি ব্যাপার এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমি তোমাকে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। শেষে না পেয়ে ভাবলাম তুমি বোধহয় বাইরে গেছে। কখন বেরুলে বাড়ি থেকে? দেখলাম চা’ও খাও নি কাপটা বারান্দায় পড়ে আছে শরীর খারাপ লাগছে।
–হ্যাঁ।
–কই বলনিতো আমাকে? কি হয়েছে?
—ঘামছি।
—ঘামছো? ঘামলে আবার শরীর খারাপ লাগে নাকি? জানতাম না তো? কখনো শুনিওনি।
–তুমি তো কটু গন্ধ পাও।
—দূর এটা একটা কথা হলো, চলো বাড়ি চলো। তোমাকে আমি দামি পারফিউম দেবো। কোনো গন্ধ থাকবে না। পারফিউম দারুণ জিনিস। ব্যবহার করা শিখতে হয়। আমি তোমাকে এসব শেখাতে চাই। কত যত্ন করে তোমার জন্য খাবার বানিয়েছি, কিছুই খেলে না।
—আমার খিদে নেই।
–সেজন্য হাঁটতে বেরিয়েছে, তা বলবে তো? ঠিক আছে, চলো বাড়ি চলো।
—আমি কিছুক্ষণ হাঁটতে চাই।
—চলো, আমিও তোমার সঙ্গে হাঁটবো। তারপর দুজনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরবো।
–না, আমি একা হাঁটতে চাই।
—একা হাঁটতে চাও? আমার সঙ্গ তোমার খারাপ লাগছে?
নিয়ামত রসুল হাঁটতে শুরু করে। মনে হয় এতক্ষণ গাছের গুঁড়ির যে সাপোর্টটা ওর দরকার ছিলো এখন আর সেটা দরকার নেই। ও নিজেকে মুক্ত করতে চায়। আফরোজা দু’কদম ওর সঙ্গে হেঁটে বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে আমি বাড়ি ফিরছি। এই পলিউশনের মধ্যে আমার হাঁটতে ভালো লাগছে না। আমি বাড়ি যাচ্ছি। আর শোন, আমি কিন্তু আর বেশি দিন এই বাড়িতে থাকবো না। একটা ভালো এলাকায় বড় বাড়ি তুমি ভাড়া করবে। এমন ছোট জায়গা ছোট বাড়িতে থাকলে মন ক্ষুদ্র হয়ে থাকবে। সামনে বাচ্চাকাচ্চা হবে। ওদের আমি বড় পরিবেশে আরাম-আয়েসে বড় করতে চাই।