তাহেরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করতে করতে ফিরে যায়। সাবিহা আবার চমকে ওঠে। নিজের খারাপ লাগার মধ্যেও ওর মনে হতে থাকে যে তাহেরা সুস্থ নেই। ওর উৎকণ্ঠা সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং বুঝতে পারে যে তাহেরার সামনে বিপদ। ওকে রক্ষা করা কঠিন।
অনিমার স্কুল ছুটি হয়েছে। প্রতিদিনের মতো ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে। এই ফেরার মধ্যে ওর ভাবনার নানা কিছু ঢুকে থাকে, যেসব নিয়ে ওর ভাবনা বিস্তৃত হয়। অনিমা জীবনের চারপাশের দেখার দেয়ালটা ভেঙে দেয়–সামনে তো দিগন্তছোঁয়া প্রান্তর, কত দূর যাবে ও–নাকি আটকে থাকবে এই মাঠে–শুধু ছেলেমেয়েরা বড় হতে থাকবে, ওরা ঢুকবে জীবনের নানা দরজা দিয়ে, কারো কারো সামনে বন্ধ থাকবে দরজা, তখন কেউ কেউ বন্ধ দরজার এপাশেই টিকে থাকার চেষ্টা করবে, যেটাকে ঠিকভাবে টিকে থাকা বলা যাবে না। অনিমার বুকটা বেদনায় ভার হয়ে ওঠে। মনে হয় এ জীবনে কিছুই পাওয়া হলো না, পথটাও বেশি পাড়ি দেয়া হলো না, ও নিজেই তো বদ্ধ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা যে খুলবে সে সুযোগ কই? তখন ও দূর থেকে তন্ময়কে দেখতে পায়।
ও উল্টো দিক থেকে কখনো ছবি তুলে, কখনো চারদিকে তাকাতে তাকাতে পাখি দেখে, হাঁটু গেড়ে বসে বুনো ফুল দেখে, ক্ষুদে পোকা দেখে এসব করতে করতে তন্ময় এগিয়ে আসে। অনিমার মনে হয়, তন্ময় বেশ আছে, ও দরজার অপর পাশের জীবনযাপন করছে। দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেতে হয়নি তন্ময়কে। অনিমার বুক খচ করে ওঠে–ও বুঝতে পারে যে ও তন্ময়কে ঈর্ষা করছে। খানিকটুকু এগিয়ে অনিমাকে দেখে ও ছুটে কাছে এসে দাঁড়ায়–একদম মুখখামুখি। অনিমাই হেসে কথা শুরু করে, এখনো ছবি তোলা শেষ হলো না আপনার?
শেষ হবে কী করে, আপনার একার ছবিই তো এখনো তোলা হয়নি। কত পোজ যে দিতে হবে তার কি শেষ আছে। দেখবেন এক একটা ছবিতে কেমন অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছেন আপনি। নিজেকে চিনতে কষ্ট হবে। মনে হবে, এ কোন অনিমা, আমি কি একে চিনি?
অনিমা হাসতে হাসতে বলে, বেশ লম্বা বক্তৃতা দিলেন। বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারেন। আমি বলি কি, আমার ছবি ওঠালে আপনার ক্যামেরা ভাঙবে।
তন্ময় অনিমার মুখের ওপর আঙুল নেড়ে বলে, ভুল, সবই ভুল, আপনার ছবি তোলার পরে আমার ক্যামেরার উজ্জ্বলতা বাড়বে। যে জ্যোতি ঝলকাবে তা–
হয়েছে, হয়েছে থামেন। অনিমা লাজুক হাসে। আমার ছেলেমেয়েরা আপনার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
রাখেন ছেলেমেয়েদের কথা, আমাকে পোজ দেবেন কখন বলেন তো?
অনিমা গম্ভীর হয়ে বলে, ভেবে দেখি।
বাব্বা, একদম রানীর গাম্ভীর্য নিয়ে কথা বলছেন। দেখবেন সময়টা যেন হয় দিনের প্রথম আলোয়, কিংবা পূর্ণিমা রাতে, অথবা আকাশ ভেঙে নেমে আসা ঘোর বৃষ্টির মধ্যে।
অনিমা উচ্ছসিত হাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসতে হাসতে বলে, কবিতা লেখেন? কবি হবেন, নাকি হয়ে গেছেন?
এই ক্যামেরাই আমার কবিতা।
অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলো কলরব করে ওঠে, আমাদের ছবি তুলে দেন স্যার।
এক একজন করে দাঁড়াও। সবার একটা করে ছবি তুলে দেব।
ছবি তুলতে তুলতে চমৎকার সময় কেটে যায় প্রতিটি ছেলেমেয়ে কত প্রাণবন্ত, কত উচ্ছল। কত দীপ্তি ওদের দুচোখে। তন্ময়ের মনে হয় এভাবে মানুষকে ধরা মানুষেরই জীবন। তারপরও একটু ফাঁক থেকে যায়, বাস্তবতার ফাঁক, জীবনযাপনের সঙ্গে যেটুকু আর মেলে না। ওদের ছবি তোলার সময় অনিমা পথের ধারে বসে থাকে। ছেলেমেয়েগুলো অন্যরকম আনন্দ পাচ্ছে, তন্ময় ওদের সময়টা ভরিয়ে দিচ্ছে, এটুকু ভেবেই অনিমা খুশিতে আপুত হয়। যাক, অল্প একটু সময় হলেও ওদের দরজা একটুখানি ফাঁক হয়েছে। অনিমা মনে মনে তন্ময়কে কৃতজ্ঞতা জানায়।
তখন খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে মাসুম আসে। ওর হাতে লাল-সবুজ পতাকা দেখতে যারা অভ্যস্ত, তারা জানে ওর লাল পতাকায় ট্রেন থামে, আর সবুজ পতাকায় ট্রেন ছাড়ে। ও এক চলন্ত ছেলে। কিন্তু ওর নেশা খঞ্জনি। খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে নাচে-গায়। অনিমার মনে হয় মাসুমও দরজার ওপারে যেতে পেরেছে। বন্ধ দরজা মাসুমের চলা আটকাতে পারেনি। ছেলেমেয়েদের ছবি তোলার মাঝখানে মাসুম এসে দাঁড়ায়। ওদের ছবি তোলা শেষ হলে ও বলে, সুন্দর কাজ করেছেন তন্ময় ভাই। এবার আমার একটা ছবি তোলেন।
সঙ্গে সঙ্গে অনিমা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তোমার একটা ছবি তোলো। তারপর অন্য একটা ছবি তোলা হবে।
তন্ময় উৎসুক হয়ে বলে, কী ছবি তোলা হবে?
ওই ছেলেমেয়েরা মাসুমের খঞ্জনি বাহিনী। ওদের একটা খঞ্জনি নৃত্যের ছবি তোলা হোক।
মাসুম লাফিয়ে উঠে বলে, ঠিক কথা। আয় পোলাপান।
ও ঝোলা থেকে খঞ্জনি বের করে ছেলেমেয়ের হাতে দেয়। ছেলেমেয়েরা খঞ্জনি বাজাতে শুরু করে। মাঠজুড়ে খঞ্জনির সুর বাতাসে মিশে ছড়াতে থাকে–গ্রামের সীমানা পেরিয়ে, অন্য গ্রামে–অন্য শহরে–কোথায় যায় না! অনিমার বুক হুহু করে। কিছু কিছু ধ্বনি অজস্র স্মৃতি তোলপাড় করে ওঠা। সে স্মৃতি বুকের এত গভীরে থাকে যে সে শব্দ নিজের কাছে শুধু পৌঁছায়ু, আর কারো কাছে নয়।
মাসুম ছেলেমেয়েদের নিয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে নাচতে নাচতে অনেক দূরে চলে যায়। তন্ময় অনেকগুলো ছবি তোলে। এই দৃশ্যটি ওর ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। দুজনেই নৃত্যরত ছেলেমেয়েদের চলে যাওয়া উপভোগ করে। একসময় তন্ময় অনিমার দিকে তাকিয়ে বলে, এখন আমাদের সময়। প্রবল হাসিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে অনিমা বলে, আমি নাচতে জানি না। আমার হাতে খঞ্জনিও নেই। ওটা বাজানো কঠিন। শিখতে হয়।