তাহের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আল্লাহ যে ক্যান আমারে একটা পোলা দিল না। সাবিহা কথা না বলে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তাহেরা। আবারও বিলাপ করে, আল্লাহ যদি আমারে একডা মাইয়াও দিত। আমি ক্যান এমন হতভাগী হইলামী
সাবিহা ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে, দুঃখ করছ কেন তাহেরা? তুমি একটা মেয়ে পালক নিলে না কেন?
আমি চাইছিলাম নিতে। আমার স্বামী রাজি অয় নাই। কয় পরের মাইয়া খাওয়াইতে পারমু না।
তোমার স্বামী যে আবার বিয়ে করল–
ওই সংসারেও কিছু অয় নাই। আল্লাহ দ্যায় নাই। আল্লায় বিচার করছে। তাহেরা বুড়ো আঙুল নেড়ে নেড়ে তার বিচারের মনোভাব প্রকাশ করে। তারপর হি-হি করে খানিকটুকু হাসে। সাবিহা বানুর কাছে তাহেরার হাসি সুস্থ মানুষের হাসির মতো মনে হয় না। ওর বুক কেমন করে। ভয়ও পায়।
তাহেরাকে শাসনের সুরে বলে, এভাবে হেসো না তাহেরা।
তাহেরা সাবিহা বানুর কথায় কর্ণপাত করে না। নিজের মতো করে ভেবে বলে, আম্মা আমি ঠিক করছি এইবার দ্যাশে গেলে কুমার বাড়ি গিয়া মাটি দিয়া পুতুল বানানো শিখুম। পরান দিতে পারমু না, কিন্তু মানুষের মতন তো হইব। মনে করমু ওইগুলা আমার সন্তান। আমি জন্ম। দিছি।
সাবিহা গভীর মমতায় উচ্চারণ করে, ওহ তাহেরা!
তাহেরা কাঁদতে শুরু করে, আম্মাগো–
সাবিহা ওর কান্নায় চিন্তিত বোধ করে। ভাবে, মনে হয় ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। আশ্চর্য, কার বুকের ভেতরে কোথায় কী কান্না আছে, কে জানে!
তাহেরা কাঁদতে কাঁদতে কপাল চাপড়ায়, খানিকটা অস্বাভাবিক আচরণ করে। মাটিতে শুয়ে পড়ে। ঘরে সাবিহা বানুর উপস্থিতি ও ভুলে যায়।
সাবিহা ওকে শান্ত করার জন্য ধমক দিয়ে বলে, এই তাহেরা ওঠো।
যাও তো দেখো বাগানে মালি কী করছে। ওকে ডেকে নিয়ে এসো।
তাহেরা চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়।
আপনে চা খাইবেন আম্মা?
সাবিহা মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ আনো, সঙ্গে দুটো বিস্কুট দিও।
তাহেরা খানিকটুকু এগিয়ে আবার ফিরে আসে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলে, আম্মা আপনের পোলারে আপনে চিঠি ল্যাখেন না?
চিঠি! সাবিহার কপাল কুঁচকে যায়, দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। হেসে বলে, আমার ছেলেটা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায় তো সেজন্য ওর ঠিকানার ঠিক থাকে না। তাই আমার লেখা হয় না, তবে ও আমাকে চিঠি লিখতে ভোলে না। দেখছ না চিঠির বাক্সটা কেমন ভরে গেছে। আমার একটা বাক্স কিনতে হবে।
তাহেরা দু-হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, এইবার একটা সিন্দুক কিনবেন আম্মা। অ্যাত্তো বড়–।
দুজনে হা-হা করে হাসতে থাকে। সাবিহার মনে হয় হাসতে বেশ লাগছে। তাহেরা কাজের বুয়া বলে হাসিটার মধ্যে কৃত্রিমতা তৈরি হবে, এমন ভাবনা ওর মধ্যে কাজ করে না। তাহেরা আবারো বলে, আম্মা আপনের পোলা আমার একডা ছবি তুলছিল। আপনে তারে কইবেন আমারে একডা ছবি দিতে।
তুমি কিছু ভেব না। ও তোমাকে ঠিকই ছবি দেবে। আর তুমি যে আমার কাছে আছ তা তো ও জানেই। একদিন দেখবে তোমার ছবি আমার চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে।
তাহেরা খুশিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, হ ঠিক। ঠিক কইছেন আম্মা। আপনে যেমুন ভালা, পোলাডাও ঠিক তেমুন। হঠাৎ করে বদলে যায় ওর আচরণ কণ্ঠে কেমন অস্বাভাবিক টান, সাবিহার কানে খট করে লাগে। তাহেরা কি সুস্থ নেই? ওর কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? সাবিহা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। সাবিহা একটু পরেই শুনতে পায় সুর করে বলা তাহেরার প্রলাপ। ছবি পামু আল্লাহরে। শেষের দিকে ওর কণ্ঠে আর্তনাদ ধ্বনিত হয়। সাবিহার বুক ধক করে ওঠে। ওর মনে হয় তাহেরা বুঝি পাগল হয়ে যাবে। সাবিহা প্রবল অস্বস্তিতে উঠে দাড়াতেই ফোন বাজে। তন্ময় কি ফোন করেছে? না, তন্ময় কখনো ফোন করে না। ফোন আসে মালিহার, ছোট বোেন। একা থাকে। পাঁচ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে বলেছিল, বেশি মানুষের সঙ্গে থাকা আমার পোষায় না। আমি নিজের মতো থাকতে চাই।
ফোন ওঠাতেই মালিহা বলে, আপু তুমি কেমন আছ?
দিন চলে যায়। ভালোই যায়। তুই কেমন আছিস?
আমি খুব আনন্দেই আছি বাপু। পবন আর আমি একসঙ্গে থাকছি।
একসঙ্গে? সাবিহা ভীত হয়ে যায়। কী বলছিস মালি?
আপু, বিষয়টা তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই বলতে পারব না। সেজন্যই তোমাকে বলছি।
ভালো করে খুলে বল।
এইটুকু বুঝতে তোমার এত সময় লাগছে?
সত্যি নিজেকে ভীষণ বোক বোকা লাগছে।
আপু, আমরা লিভ টুগেদার করছি। বিয়েটিয়ে করা আমার হবে না।
ওতে আমার বিশ্বাসও নেই। কী হলো, চুপ মেরে গেলে যে?
তোর ইচ্ছের ওপর আমার কি কোনো হাত আছে রে!
হা-হা করে হাসে মালিহা। হাসতে হাসতে বলে, একদিন পবনকে নিয়ে আসব। তোমার স্পেশাল কিছু রান্না আছে, সেগুলো করবে। রাগ করবে না তো?
তুই আমাকে চিনিস না মালিহা?
চিনব না কেন? তুমি আমার সুইট বোন। রাখি। বাইরে কোথাও যাবার কথা ভাবছি। যাবার আগে তোমাকে বলে যাব। রাখি আপু। ও আচ্ছা শোনো, মাকে কিন্তু তুমি কিছু বলো না। ওল্ড ভ্যালুসের মানুষ–বিশাল একটা ধাক্কা খাবে। মাকে ধাক্কাটা দিতে চাই না।
হয়েছে থাম। অনেক কথা বলছিস।
আর কথা না বলে মালিহা ফোন রেখে দেয়। সাবিহা ব্ৰিত বোধ করে। ভীষণ মন খারাপ হয়। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। তন্ময়ের কথা ভেবে বুক তোলপাড় করে। তারপরও সাবিহা নিজেকে ঠিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় বালিশে মুখ গোঁজে। আসলে জীবনের সবটুকু খতিয়ান মেলাতে পারে না। ও মালিহার মতো সাহসী নয়, যা খুশি তা করার জন্য পা বাড়াতে পারে না, ভয় পায় এবং ভীতি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে ছকবাঁধা জীবনের কুঠরিতে আটকে রাখে। এটুকুতেই সে নিজের স্বস্তি খোঁজে। তাহেরা চা-বিস্কুট নিয়ে এলে ও বলে, এখন খাব না। তুমি নিয়ে যাও।