নদী আছে কি-না খুঁজে দেখুন। অনেক ভালো সাবজেক্টও পেয়ে যেতে পারেন। এখানে কার কাছে এসেছেন? পরিচিত কেউ?
তন্ময় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আমার নাম আশরাফুল হক তন্ময়। আপনি আমাকে তন্ময় করে ডাকবেন। আমি ভীষণ খুশি হবো।
খুশি! তৌফিক ভ্রূ কুঁচকায়।
তন্ময় তড়িঘড়ি বলে, আমার বাবা নেই।
আমার মেয়েটিরও মা নেই।
দুজনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হো-হো করে হাসে তৌফিক। বলে, এই না থাকার ভাবনায় আমি বেশ আনন্দ পাই।
আনন্দ! তন্ময় একটু ভেবে বলে, হ্যাঁ, আমার মনে হচ্ছে আমিও আনন্দ পাই।
তুমিও আনন্দ পাও? বেশ ছেলে তো! আমার না হয় বয়স হয়েছে। চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নেই। যে কোনো সময় দম ফুরিয়ে যাবে। তোমার সামনে লম্বা জীবন।
ভাবলেই লম্বা হয়, না ভাবলে ছোট।
তৌফিক তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোথা থেকে উড়ে এসে ছেলেটি এমন টানটান কথা বলছে! জড়তা নেই, চঞ্চলতা নেই। গম্ভীর, বয়সি ভাবের চেহারা।
আমি আপনার একটা ছবি তুলি?
তৌফিক ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয়। তন্ময় ছবি তোলে। তারপর ব্যাগ থেকে সাবিহা বানুর ছবি বের করে দেখিয়ে বলে, এটা আমার মায়ের। ছবি।
তৌফিক ছবিটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখে। স্মৃতি তাড়িত হয়। তন্ময়কে আপন ভেবে অন্তরঙ্গ স্বরে বলে, তোমার মায়ের সঙ্গে অনিমার মায়ের খুব সুন্দর মিল আছে তন্ময়।
কেমন মিল?
দু’জনের হাসিতে গালে টোল পড়ে।
হো-হো করে হাসে তন্ময়।
হাসছ যে?
মানুষের চেহারায় নতুন নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি ছবি তুলি।
০২. ঘরে বসে বাবার কথা খুব মনে হয় অনিমার
ঘরে বসে বাবার কথা খুব মনে হয় অনিমার। বাবাকে একা রেখে অন্য আর একটি সংসারে ঢোকা কি ওর পক্ষে সম্ভব হবে? পরক্ষণে রাজীব ওকে আচ্ছন্ন করে। ও একটি সাদা কাগজে আঁকিবুকি কাটে। নিজেকেই বলে, বলেছিলে ফিরে আসবে। আসছ না কেন? আর কত দিন অপেক্ষা করব আমি? কত দিন ট্রেন এলে ছুটে যাব স্টেশনে।
ও কাগজটা ভাঁজ করে পাখি বানায়। সেটা ছুঁড়ে দেয় উপরে। বলে, জানি এ চিঠি কোনো দিন তোমার কাছে পৌঁছাবে না। ভীষণ মনে পড়ে, একদিন রাজীব আর ও একটি কাঠঠোকরা পাখির বাসা খুঁজতে অনেক দূরে গিয়েছিল। রাজীব ওকে হাত উঁচিয়ে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া অতিথি পাখির সারি দেখিয়েছিল। ও বাবার অফিসে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়।
তখন তৌফিক তন্ময়কে জিজ্ঞেস করে, তুমি আমাকে নদীর কথা জিজ্ঞেস করেছিলে কেন?
আমি প্রকৃতি ভালোবাসি। কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য আছে, মানুষের মতো চেহারার রকমফের নেই। প্রকৃতির ভেতর সম্পর্ক তৈরি হয় না।
প্রকৃতির চেহারার অনেক রকমফের আছে। জায়গাভেদে প্রকৃতির ভিন্নতা তুমি দেখোনি? প্রকৃতির ভেতরে সম্পর্কও তৈরি হয়। একশবার হয়।
হয়, কীভাবে?
মৌমাছি ফুলের পরাগরেণু দিয়ে প্রকৃতিতে জীবনের সঞ্চার ঘটায়। শাপলা ফুলের পরাগায়ন হয় নদীর মাধ্যমে। বাতাসেও পরাগায়ন হয়। নদী পলিমাটি ফেলে জমি উর্বর করে। এগুলো কি সম্পর্ক নয়?
তন্ময় এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, এত গভীর কথার উত্তর আমার জানা নেই। তবে মানব সম্পর্কের মধ্যে যে সুখ-দুঃখ, আনন্দবেদনা আছে তা প্রকৃতির নেই। আমি আপনার আর একটা ছবি তুলি?
তোল। ছবির কপি তুমি আমার মেয়েটাকে দিও কিন্তু।
তন্ময়ের ক্যামেরা ক্লিক করে। ও ক্যামেরা ব্যাগে ঢোকানোর আগেই অনিমা ঢোকে। তৌফিক হেসে বলে, আয় মা। দেখ কেমন পাগলের পাল্লায় পড়েছি। এই ছেলেটার নাম তন্ময়। ছবি তোলা ওর নেশা।
অনিমা তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, আপনাকে আমি ট্রেন থেকে নামতে দেখেছি।
তন্ময় অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, জানি।
তৌফিক প্রবল উচ্ছাসে বলে, এই ছেলে, তুমি আমার মেয়ের সঙ্গে একটা ছবি তুলে দাও।
অনিমা লজ্জা পায়। বাবার পিঠে হাত রেখে বলে, আহ্ বাবা তুমি যে কি?
লজ্জা পাচ্ছিস কেন মা, আয়।
হ্যাঁ, আসুন, এখানে দাঁড়ান। ছবি তুলতে আমি ভীষণ ভালোবাসি।
বাবা-মেয়ে তন্ময়ের ক্যামেরায় পোজ দেয়। তন্ময় ছবি তুলে দিয়ে চলে যায়।
সাবিহা বানু তখন গভীর আগ্রহে তন্ময়ের চিঠি পড়ে। কাজ শেষে তাহেরা এসে সাবিহা বানুর কাছে বসে। বলে, আম্মা এটটু ঠাণ্ডা হইতে আইলাম। সাবিহা ওর কথায় মাথা নাড়ে। কিন্তু তন্ময়ের চিঠি থেকে চোখ ওঠে না তার, মা, আমার রুপালি মা আমার, আমি এখন একটি ছোট্ট স্টেশন, নাম ফুলমসি। স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ভদ্রলোক যথেষ্ট বুড়ো নয়, কিন্তু ভেতরটা বুড়িয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়েছে। মানুষের এই বুড়িয়ে যাওয়া দেখতে আমার ভালো লাগে না। তার স্ত্রী মারা গেছে। একটি মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ঠিক আমাদের মতো মা। যেমন একটি ছেলে নিয়ে তোমার সংসার। হাঃ হাঃ। ইতি তোমার আদরের রবীন্দ্রনাথ তন্ময়।
সাবিহা মৃদু হেসে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর তন্ময়ের লেখা চিঠির বাক্সে ভাঁজ করে রেখে দেয়।
তাহেরা কৌতূহলী কণ্ঠে বলে, এতক্ষণ আপনের পোলার চিঠি পড়লেন আম্মা?
সাবিহা মাথা নাড়ে।
ওর চিঠি পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। এই চিঠিটাই আমাদের মা-ছেলের সেতু। ছেলেটা ঠিকই টের পায় যে আমি কখন ওর একটা চিঠির জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠি।
তাহেরা খুশি হয়ে বলে, এরেই কয় মায়ের লগে পুতের নাড়ির টান।
সাবিহা চমকে ওঠে, নাড়ির টান! তারপরেই তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তারপর বিষণ্ণ হয়। শেষে উৎফুল্ল হয়ে বলে, না-না নাড়ির সম্পর্কটম্পর্ক কিছু না তাহেরা, ভালোবাসা একদম ভিন্ন জিনিস–ভালোবাসতে জানলে মানুষের অনেক অভাব পূরণ হয়।