তোমরা গিয়েই দেখো না। দিতেও তো পারে।
অনিমার কথার প্রতিধ্বনি ওরাও করে, হ্যাঁ দিতেও তো পারে। চল দৌড়াই।
অনিমার মনে হয় ওরাও একঝাঁক চড়ুইয়ের মতো উড়ে যাচ্ছে। ওরাও উড়ে যাবে নীলিমার কাছে। বলবে, আকাশ, আমরা এসেছি। আমাদেরকে বৃষ্টি দাও, রোদ দাও। ধান দাও। ভাত খাব, খঞ্জনি বাজাব, পূর্ণিমার রাতে উৎসব করব। আমাদের অনেক কিছু করার আছে আকাশ। এসব ভাবনা ভাবনাই। অনিমার মন আবার খারাপ হয়ে যায়। দেখতে পায় ছেলেমেয়েরা মাসুমকে ঘিরে ধরেছে। ও বাড়ির পথে যায়।
দুলি বলে, আপনার হাতটা আমাদের দিকে বাড়ান মাসুম ভাই।
মাসুম হকচকিয়ে যায়। ভ্রু উঁচিয়ে বলে, কেন?
আপা আমাদেরকে বলেছে মানুষকে ছুঁতে। আমরা আপনাকে ছোঁব।
আপা যখন বলেছে তাহলে তো সেটা মানতেই হবে।
মাসুম ওর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ধরো।
ছেলেমেয়েরা ওকে সঙ্গে নিয়ে নাচতে থাকে। সুর করে গায়–‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি/রেলগাড়ি ঝমাঝম/পা পিছলে আলুর দম…।’ নাচতে নাচতে ছেলেমেয়েরা ইচ্ছা করে পড়ে যায়। আর হি-হি করে হাসতে হাসতে বলে, মাসুম ভাই আমাদের যদু মাস্টার। মাসুম অই রেলগাড়িতে চড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে। আমরা সবাই বরযাত্রী হবো।
হি-হি করে হাসে সবাই। মাসুম ওদের ধমক দিয়ে বলে, অ্যাই পোলাপান থাম। থাম বলছি।
ওরা হাসতে হাসতে খালি প্লাটফর্মে দৌড়াদৌড়ি করে।
অনিমা তখন নিজের শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দু-হাতে মুখ ঢাকে। রাজীবের কোনো ছবি নেই ওর কাছে। এত অল্প সময়ের পরিচয়ে ছবি রাখা হয়নি। ভেবেছিল সুযোগ হলে দুজনে একটা ছবি তুলবে। সে সুযোগ আর হলো না। মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে বলে, মা বড় শূন্য করে রেখে গেলে আমাদের। এই খালি ঘরটা খাঁ-খাঁ করে। একজনের না থাকা যে কত ভয়াবহ তুমি কি তা কখনো বুঝেছিলে মা!
অনিমা নিজেকে সামলে নিয়ে স্নান করতে যায়। হঠাৎ ট্রেনের শব্দ ওকে চমকে দেয়। বাথরুমে আর ঢোকা হয় না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোঝে যে বাবুগঞ্জের ট্রেনটা এসেছে। ও দ্রুত বাইরে এসে দাঁড়ায়। রাজীবের জন্য ওর অপেক্ষা ফুরোয় না।
ট্রেন থেকে নামে তন্ময়। কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ। সঙ্গে আর একটি ছোট ব্যাগ। ট্রেন চলে গেলেও ও দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন কোন দিকে যাবে বুঝতে পারে না। নতুন জায়গায় তো ঝট করে পা বাড়ানো যায় না। দূর থেকে অনিমার দিকে চোখ পড়ে। দৃষ্টি ফিরিয়ে সবুজ ফ্ল্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মাসুমের দিকে চোখ পড়ে। বেশ লাগে ওকে দেখতে। জিজ্ঞেস না করেই ওর একটা ছবি তোলে।
মাসুম দু-পা এগিয়ে এসে বলে, ছবি তুললেন যে?
তন্ময় ওর ঘাড়ে হাত রেখে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলে, ছবি তোলা নেশা। ছবির মধ্যে মানুষ খুঁজি। অনেকগুলো ছবি একসঙ্গে করলে মানুষের মুখ যে কত রকম হয় তা বোঝা যায়।
মাসুম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, তাতে আপনার কী লাভ?
তন্ময় মাথা নাড়ে। ঘনঘন মাথা নাড়লে ওর চুলগুলো কপালের ওপর ছড়িয়ে যায়। অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বলে, লাভ? লাভের কথা ভেবে দেখিনি কখনো। ওটা ভীষণ কঠিন কাজ।
আপনি কী করেন?
এই ছবিই তুলি।
এতে রোজগার হয়?
রোজগার!
মানে নিজের খরচ চালান কী দিয়ে?
এর মধ্যে তন্ময়ের দৃষ্টি আবার অনিমার দিকে যায়। দেখতে পায় অনিমাও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও ভেতরে ভেতরে কৌতুক বোধ করে। পরক্ষণে মাসুমের দিকে তাকিয়ে বলে, ও হ্যাঁ, খরচের কথা বলছিলে তো। মা আমাকে ছবি তোলার পড়ালেখার জন্য বৃত্তি দেয়। সেই টাকা দিয়ে আমি লেখাপড়া করি।
আপনার মায়ের বুঝি অনেক টাকা?
হ্যাঁ, অনেক টাকা।
ইস আমার যদি এমন মা থাকত! আমার মায়ের কেবল অভাব।
টাকাঅলা মা থাকলে কী করতে?
আমার গাঁয়ের সব ছেলেমেয়েকে খঞ্জনি বাজানো শেখাতাম।
হা-হা করে হেসে ওঠে তন্ময়। হাসতে হাসতে দেখতে পায় অনিমা আর নেই। ও বাড়িতে ঢুকে গেছে। যে দেয়ালের গায়ে ও হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে নিশ্চয় অনিমার ফসিলের চিত্র আছে। যারা মুহূর্তে অদৃশ্য হয় তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন। তন্ময়কে স্টেশন মাস্টারের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাসুম তিক্ত স্বরে বলে, আপনি এই স্টেশনে নেমেছেন কেন?
এমনি। আমি এমনই করি। ট্রেনে, লঞ্চে, বাসে ঘুরতে ঘুরতে কোথাও নেমে যাই। কিছুদিন সে জায়গা দেখি। আবার অন্য কোথাও চলে যাই।
আজব মানুষ! এমন মানুষ দেখিনি।
তন্ময় ওর পিঠে হাত রেখে বলে, আবার তোমার সঙ্গে কথা হবে।
ও স্টেশন মাস্টারের অফিসের দিকে এগিয়ে যায়। তৌফিক উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। বাইরে দাঁড়িয়েও তন্ময় স্পষ্ট তার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। সেজন্য সে স্টেশন মাস্টারের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।
তৌফিক বলে যাচ্ছে, কী বললেন, ট্রেন আটকে গেছে! আমি তো আমার স্টেশন থেকে ট্রেনটা ঠিকঠাক মতো পার করে দিয়েছি। ওহ হো, লাইনে সমস্যা? ঠিক আছে দেখি এদিক থেকে কী করা যায়।
কথা শেষ হয়ে গেছে, তন্ময় মৃদু কণ্ঠে বলে, আসতে পারি স্যার?
তৌফিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখে অবাক হয়ে বলে, আসুন। আমার কাছে কোনো দরকার?
আপনার এই গাঁয়ে নদী আছে?
কেন থাকবে না! বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। ভূগোলে পড়েননি?
জি পড়েছি। বাবা-মা আমাকে খুব যত্ন করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন।
তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
ছবি তুলব তো সেজন্য। নদী আমার একটি ভীষণ প্রিয় সাবজেক্ট।