তন্ময় সন্তান প্রসঙ্গে না গিয়ে বলে, আপনি এখন কী করবেন?
তাহেরা সহজ কণ্ঠে বলে, একড়া বাসায় কাম লমু।
বাসায় কাজ নেবেন? একটু ভেবে ও বলে, আমি আপনাকে একটা বাসা ঠিক করে দেব। থাকবেন? ভালো বাসা। আপনার কোনো কষ্ট হবে না।
তোমার কেউ হয় বুঝি? তোমার কেউ হইলে আমি একশবার থাকমু।
আপনি বসেন, আমি একটা চিঠি লিখে দেই।
তন্ময় ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিঠি লেখে–‘সোনা মা আমার, আমি তোমার একজন সঙ্গী পাঠালাম। তুমি তাকে বাসায় থাকতে দিও রিজিয়া বুয়া চলে যাওয়ার পরে তুমি বড় একা হয়ে গেছ। এসব গ্রামের মানুষের জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা থাকে মা। আমার বিশ্বাস যাকে পাঠাচ্ছি তার সঙ্গ তোমার ভালো লাগবে মা। আর যদি ভালো না লাগে তাহলে বিদায় করে দেয়ার পথ তো খোলাই থাকে। আমাদের মানবিক বোধে বড় ঘাটতি আছে মা। তোমার নটেগাছ তন্ময়।’
চিঠিটা ভাঁজ করে তাহেরাকে দেয় তন্ময়।
আমি যে বাড়িতে আপনাকে রেখে আসব তাঁর কাছে গিয়ে চিঠিটা দেবেন।
তাহের ভীত কণ্ঠে বলে, আমারে যদি ভাগায়ে দ্যায়? তহন আমি কই যামু?
আপনি বাড়ির গৃহিণীকে এই চিঠিটা দিলে তিনি আপনাকে ভাগাবেন। আর যদি ভাগিয়ে দেন তাহলে অন্য একটা বাসা খুঁজে নেবেন। পারবেন না?
তাহেরা সজোরে মাথা নেড়ে বলে, খুব পারমু। পথে নামতে পারছি। আর পথ চিনতে পারমু না!
অকৃত্রিম সরল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাহেরার মুখ। তন্ময় মুগ্ধ হয়ে যায়। এমন চেহারাই তো ও পথে পথে দেখতে চায়। ক্যামেরা বের করতে করতে বলে, আপনি খুব সাহসী মহিলা চাচি। আপনার একটা ছবি তুলি?
তাহেরা খুশি হয়ে বলে, ছবি তুলবা বাবা, তোল তোল। সোন্দর কইরা তুলবা। আমারে য্যান পরীর মতো দেহায়।
তাহেরা শাড়িটা টেনেটুনে ঠিক করে পোজ দেয়। তন্ময় আপন আনন্দে অনেকগুলো ছবি তোলে। তারপর তাহেরাকে নিজের বাড়ির গেটে পৌঁছে দিয়ে দারোয়ানকে বলে, ওনাকে মায়ের কাছে নিয়ে যান।
তুমি যাইবা না বাবা?
না, আমার একটু কাজ আছে। ভয় নেই, আপনি গিয়ে মাকে আমার চিঠি দেখান।
তাহেরা দারোয়ানের সঙ্গে সাবিহা বানুর কাছে গিয়ে চিঠিটা দেয়। সোফায় বসে সাবিহা বানু চিঠিটা পড়ে। দুর-তিনবার পড়ে। তাহেরা মেঝেতে বসে আছে। উত্তষ্ঠা, দুরুদুরু বুক। এ বাড়িতে একটা ঠাঁই মিলবে তো? সাবিহা চিঠি পড়ে তাহেরীর দিকে তাকায়। মৃদু হেসে বলে, আমার ছেলে তোমাকে পছন্দ করেছে। আমার কি সাধ্য আছে ওর হুকুম পালন না করার! পালন করতে না পারলে আমার বুক ভেঙে যাবে।
তাহেরা সাবিহা বানুর কথায় সুর ধরতে না পেরে বলে, পোলাডা খুব ভালো আম্মা। আপনের কে হয়?
সাবিহা চমকে ওঠে।
আমার কে হয়? তারপর চমক ভাঙলে দ্রুত কণ্ঠে বলে, আমার ছেলে হয়, ছেলে, ছেলে। হ্যাঁ, ও খুব ভালো ছেলে। আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।
পরক্ষণে ম্লান হয়ে যায় দৃষ্টি। চিঠিটা হাতে নিয়ে তন্ময়ের ঘরে আসে। পেছনে তাহেরাও। চিঠিটা বাক্সে রেখে তাহেরার দিকে তাকিয়ে বলে, এটা আমার ছেলের ঘর। তোমার নিজ হাতে ঝেড়েমুছে রাখবে।
এইডা তো আমার লাইগা একডা পবিত্র ঘর। আল্লাহর রহমত। আম্মা খাড়ান, আপনেরে একটা সালাম করি।
তাহেরা সাবিহার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। সাবিহা নিজের মনেই বলে, পাগল ছেলেটা যে এখন কোথায় আছে!
তন্ময় তখন আবার কমলাপুর রেল স্টেশনে ফিরে এসেছে। ট্রেনে উঠেছে। ট্রেন চলতে শুরু করলে ও কিছুক্ষণ সিটের গায়ে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে থাকে। শহরের জঞ্জালভরা এলাকাটা পার হয়ে গেলে তবে ও জানালা দিয়ে তাকাবে নিসর্গ এবং মানুষ দেখার জন্য। অনেকক্ষণ পরে ও ব্যাগ থেকে লেখার প্যাড বের করে মাকে চিঠি লেখে : সোনা মা আমার–। ইতি তোমার সাদা কবুতর তন্ময়। কাগজটা জানালা দিয়ে উড়িয়ে দেয়। উড়ে যাওয়া কাগজটার একটা ছবি তোলে।
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনিমার মনে হয় ওর চারদিকের নেমে আসা আকাশের ঘেরাটোপে ও বন্দি। চারদিকে ছোপ ছোপ রঙের মতো দুঃখগুলো সাঁটা হয়ে আছে। যেদিকেই দৃষ্টি পড়ে সেখানেই রাজীবের মুখ। রক্তাক্ত। রাজপথের পিচের সঙ্গে সেঁটে থাকা এবং খ্যাতলানো। মেঠোপথের কোথাও বসে পড়বে কি-না ভাবতেই মাঠের চড়ইগুলো ঝাক বেঁধে উড়ে যায়। ওর আর বসা হয় না। দেখতে পায় স্কুলের কয়েকটি ছেলেমেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ওর দিকে আসছে। অনিমা খুশি হয়ে ভাবে, ওরা আমার আশ্রয়। ও ওদের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। দূর থেকে স্টেশনটা স্পষ্ট দেখা ঋচ্ছে। লাইনম্যান মাসুম এক কোনায় বসে আপন মনে খঞ্জনি বাজায়। অনিমা একটি বুনোফুল তুলে খোঁপায় পরে। মনে মনে বলে, তোমায় দেব বলে এই ফুলটি খোপায় রাখলাম প্রিয়তম।
ও ছেলেমেয়েরা কাছে এসে বলে, আপা আমরা এসেছি।
বেশ করেছ। এখন তোমরা একটা দৌড় দাও তো, দেখি কে আগে যেতে পারে।
দুলি বলে, আমরা গিয়ে কী ছোঁব?
মন্টু মহাউৎসাহে আঙুল তুলে বলে, ওই দূরের গাছটা।
অনিমা ঘাড় নাড়ে, গাছ নয়, তোমাদেরকে মানুষ ছুঁতে হবে।
সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে, হ্যাঁ, আমরা মানুষ ছোঁব।
অনিমা বলে দেয়, ওই যে স্টেশনের প্লাটফর্মে লাইনম্যান মাসুম বসে আছে তাকে ছুঁতে হবে।
ছেলেমেয়েরা হৈচৈ করে ওঠে, ঠিক আছে তাই হবে। আমরা গেলাম মাসুম ভাইকে ছুঁতে।
মন্টু অনিমাকে ছুঁয়ে বলে, আপা আমরা মাসুম ভাইকে গিয়ে বলব, আপনার খনিটা আমাকে দেন।
সাবু সঙ্গে সঙ্গে বলে, দেবে কচু। খঞ্জনি মাসুম ভাইয়ের প্রাণের জিনিস।