আপা দেখেন, চাচি শহরে কাজ খুঁজতে যাচ্ছে। গাঁয়ে আর থাকবে না।
অনিমা চোখের জল মুছে বলে, কী হয়েছে চাচি?
কিছু হয় নাই।
তাহেরা বেঞ্চের ওপর বসে। অনিমা জানে কয়েক মাস আগে তাহেরার স্বামী আর একটা বিয়ে করেছে। ওদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। সে দুঃখেই তাহেরা বাড়ি ছাড়ছে। বাড়ি ছাড়লেই কি তাহেরার ঠিকানা খোজা শেষ হবে? অনিমা তাহের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কত বয়স হবে? তিরিশ থেকে চল্লিশ, নাকি আরো কম। গ্রামের মেয়েরা পুষ্টির অভাবে দ্রুত স্বাস্থ্য হারায়। তাদের বয়সটা চোরা-বয়স হয়।
কী দেখো মা?
আপনার সাহস আছে।
সংসারে লাথি মারা কি সাহস?
অনেক বড় সাহস। আপনি তো মুখ বুজে সহ্য করেননি।
ফুঃ। তাহেরা ঠোঁট ওল্টায়। তুমি কাঁদছিলা কেন?
এমনি।
তখন হুস-হুস শব্দে ট্রেন ঢোকে। লোকজন যে যার মতো গাড়িতে ওঠার জন্য তৈরি হয়। তাহেরাও পোটলা নিয়ে রেডি হয়। যাবার আগে অনিমার হাত ধরে চাপ দেয়। অনিমা কিছু বলার আগেই চলে যায়। ওর মনে হয় মানুষটি কি ওকে শক্তি সঞ্চয়ের সাহস দিয়ে গেল? আহ, ওর চোখ আবার জলে ভরে যায়। মাসুম সবুজ পতাকা ওড়াচ্ছে। ট্রেন স্টেশন ছাড়িয়ে চলে যায়, লেজটুকুও আর দেখা যাচ্ছে না। মাসুম ওকে ডাকে।
আপা, বাড়ি যাবেন না? ওঠেন আপা।
অনিমা ওর সঙ্গে কথা না বলে বাবার অফিস ঘরে গিয়ে ঢোকে। তৌফিক কাজ থেকে মুখ না তুলেই বলে, আয় মা।
তুমি আমার দিকে তো তাকালে না বাবা?
আমার মেয়ের পায়ের শব্দ আমার বুকের ভেতর টুনটুন বাজে। তাই মুহূর্তে বুঝে যাই যে কে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাবা, আমার প্রিয় বাবা।
আজ কেমন লাগল তোর ট্রেন চলে যাওয়ার দৃশ্য?
বাবা তোমাকে না বলেছি আমি যত দৃশ্য দেখি এটা হলো সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য।
তৌফিক কাজ থামিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে পেপারওয়েটটা ঘোরায়। টেবিলের ওপর মৃদু শব্দ হয়। যেন কোনো ছন্দে বোল উঠেছে। অনিমা কান পেতে শব্দ শোনে। তারপর বলে, বাবা তুমি কোনো বড় স্টেশনে বদলির চেষ্টা করো।
কেন মা?
তাহলে আমার এম.এ পড়া হবে।
তৌফিক হেসে বলে, বি.এ পাস করেছিস, এই তো অনেক। লেখাপড়া কি শুধু ডিগ্রি দিয়ে হয়? আমি চাই এর চেয়েও ছোট কোনো স্টেশনে যেতে।
অনিমার কৌতূহলী কণ্ঠের উচ্চারণ, কেন বাবা?
তৌফিক একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, তোর মা ছোট স্টেশনে থাকতে ভালোবাসত।
তখন আমি ছোট ছিলাম বাবা। প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম।
তুই চাইলে তোকে আমি হোস্টেলে রেখে এম.এ পড়ার সুযোগ করে দিতে পারি। তুই আমার একটা মাত্র মেয়ে। তোর খরচ আমি চালাতে পারব।
অনিমা অভিমানী কণ্ঠে বলে, তোমাকে ছেড়ে যাবার কথা আমি ভাবি বাবা। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।
ছিঃ মা, আমি তা ভেবে বলিনি। তুই আমাকে ছেড়ে যাবি কেন, পড়তে যাবি। বড় জায়গায় যাবি, ক্যারিয়ার গড়বি। শুধু কি প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেই হবে। তাই না? তুই যেখানে যাবি আমিও তোর সঙ্গে সেখানে যাব।
স্বপ্নের মতো লাগছে তোমার কথা শুনতে। তোমার মতো বাবা আছে বলেই তো আমি মায়ের কষ্ট ভুলে থাকতে পারি।
বাবাকে শুধু বলা হয় না যে রাজীব নেই। রাজীব না থাকার দুঃখ বাবার কথায় আশ্রয় পায়। বাড়ি ফিরে তৈরি হয়ে স্কুলে যায়। স্কুলের ছেলেমেয়েরা ওর আরেক আশ্রয়। কত গরিব ঘর থেকে ওরা পড়তে এসেছে। গান শুনতে ভালোবাসে। ছবি আঁকতে চায়। বোর্ডে অঙ্ক করতে দিলে অনায়াসে যোগ-বিয়োগ করে ফেলে। এইসব ছেলেমেয়ে এই গাঁয়ের সীমানার পরে আর কিছু চেনে না। তবুও আজ বারবার ওর মন খারাপ হয়ে যায়। স্কুলের হেড মাস্টার আজ আসেনি। অন্য টিচাররা নানা কাজের অজুহাতে চলে গেছে। তখন পুরো স্কুলে নিজেকে একা মনে হয় না, মনে হয় ঈশ্বরের মতো, পুরো পৃথিবীটা নিজের হাতের মুঠোয় পাওয়ার আনন্দ। ও সব ছেলেমেয়েকে এক ক্লাসে ডেকে বলে, আজ আমি তোমাদের একটা গান শেখাব। রোজ যেমন শেখাই, তেমন। তবে আজ হবে নতুন গান।
আমরা শিখব আপা।
তৈয়বা বিষণ্ণ মুখে বলে, আপা আমি বাড়ি যাব।
কেন? তোমার কী হয়েছে তৈয়বা?
আমার মায়ের অসুখ।
ঠিক আছে তুমি যাও। আমি বিকেলে তোমার মাকে দেখতে যাব।
অনিমা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতে চাইলেও ওর কোনো গান মনে আসে না। ওর বুকের ভেতরটা যে স্তব্ধ হয়েছে সে ঘোর ওর কাটেনি। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে চোখ মুছে বলে, তোমরা বাড়ি যাও সবাই। আজ ছুটি।
ছুটি?
হ্যাঁ।
আমরা আপনার বাড়ি পর্যন্ত যাব। আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব আপা।
না, তোমাদের উল্টো দিকে যেতে হবে না।
না, আমরা যাব।
কেন?
আপনার যে মন খারাপ সেজন্য।
ঠিক আছে এসো।
মেঠোপথে আজ অনিমার পা চলে না। ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে ওর শেখানো গান গাইছে। একদল ওর সামনে, একদল পেছনে। কিন্তু অনিমার মনে হয় ও কিছু শুনতে পাচ্ছে না। ওর এমন করে বধির হয়ে যাওয়া বড় কষ্টের।
কমলাপুর রেল স্টেশনে তন্ময় চুপচাপ বসে আছে। জুতসই কোনো দৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে না, ক্যামেরা ব্যাগেই বন্দি। খানিকটুকু অস্থিরতায় ফাঁকা ফ্লাটফর্মে ঘোরাফেরা করে। একসময় তাহেরাকে দেখে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তাহেরা ওকে দেখেই বলে, তোমারে আমার চেনা চেনা লাগে কেন বাজান?
তন্ময় মৃদু হেসে বলে, আর একজনমে আপনি বোধহয় আমার মা ছিলেন।
তাহেরা ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত স্বরে বলে, মা আছিলাম? না আমার কোনো সন্তান হয় নাই। এর লাইগাই তো আমার স্বামী আবার বিয়া করছে। সেই দুঃখে আমি বাড়ি ছাইড়া চইলা আসছি। আল্লাহ যে ক্যান আমারে একটা সন্তান দিল না।