কান্দেন ক্যান মাসুম ভাই?
আপা যে থাকবে না সেজন্য মন পোড়ে।
ঠিক। আমারও দুঃখ লাগে।
অন্যরা হৈচৈ করছে। মাসুম দুহাতে চোখ মুছে ওদের সঙ্গে মিলে যায়।
পরদিন বিয়ে। কনে সেজে বসে থাকে অনিমা। চমৎকার বেনারসি শাড়ি এনেছে, সঙ্গে হালকা গয়না, কসমেটিকস। অনিমা তাকিয়ে দেখেই বোঝে যে ওদের সাধ্য অনুযায়ীই ওরা এনেছে। একটু পরেই বরের বেশে তারেক ঢুকবে বাড়িতে। সবটাই খুব সাজানো, খুবই সংক্ষিপ্ত মনে হয় অনিমার। জীবনের বিশাল একটি পর্ব কেমন ধূলিমলিন বাস্তবতায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। এই পর্ব আর টেনে তোলা যাবে না। ওটাকে ধুলোবালির নিচে আড়াল করে টেনে তোলা যাবে না। এর বেশি কিছু ও আর ভাবতে পারে না। ভাবাটা সঙ্গত নয়। শুধু তন্ময়ের স্মৃতি বুকের ফ্রেমে উজ্জ্বল। যে ছবি তন্ময় উঠিয়েছিল তার কোনো কপি অনিমার কাছে নেই। কথা ছিল তন্ময় ঢাকায় গিয়ে প্রিন্ট করে আনবে। অনিমা নিজেকে শক্ত করে বলে, ওই ছবিগুলো আমি চাই না। তুমি তো কত জায়গাতেই যাও, কোনো এক জায়গায় ফেলে দিও। তন্ময় এখন ওর স্মৃতির মানুষ। বিয়ে পড়ানোর সময় তৌফিক নিজের মেয়েকে চিনতে পারে না। তৌফিকের বুক মুচড়ে ওঠে, ও এতটাই অচেনা হয়ে গেল কেন? এই অন্য অনিমা কি আমার মেয়ে? তৌফিকের কান্নায় উপস্থিত সকলে চমকে ওর দিকে তাকায়।
গভীর রাতে তারেক অনিমাকে বলে, চলো বাইরে যাই।
বাইরে।
হ্যাঁ, দেখো কী সুন্দর পূর্ণিমা। তুমি চাইলে আমরা রেললাইন ধরে অনেক দূর চলে যেতে পারি। যাবে?
স্টেশনের প্লাটফর্ম পর্যন্ত যেতে পারি। এর বেশি নয়।
তারেক ওকে বুকে নিয়ে বলে, এত ছোট স্বপ্ন! তোমাকে ছাড়া আমি। কখনো কারো কথা ভাবিনি। তোমাকে না পেলে আমি বিয়ে করতাম না। সারা জীবন একা থাকতাম। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি, একটুও মিথ্যে না।
দুজনে হাত ধরে বাইরে আসে। সুনসান রাত। পাখির ডাকও নেই। শুধু ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় চরাচর প্লাবিত হয়ে আছে। প্লাটফর্মের কাঠের বেঞ্চে দুজনে বসলে অনিমার মনে হয় পূর্ণিমা আছে বলে দুঃখ। খোলা যায়। তারেকের মতো ছেলেদের হৃদয়জুড়ে পূর্ণিমা।
একদিন পরেই বিকেলে ট্রেন আসার শব্দে মুচড়ে ওঠে অনিমার বুক। ও নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে না। স্মৃতি এখনো ভীষণ তাজা। সামাজিকভাবে ওর আর কারো জন্য অপেক্ষা করার অনুমোদন নেই। কিন্তু বুকের গভীরে নিজেকে আড়াল করবে কোথায়? ও জায়গাটুকু ওর একার। ওখানে ও যে কাউকে রাখতে পারে, যে কারো কথা ভাবতে পারে যতদিন খুশি ততদিন। ও দু-কান ভরে ট্রেনের শব্দ শোনে–শুনতে ওর ভালো লাগে। সেই আনন্দ নিয়ে তারেককে বলে, তুমি চা খাবে?
না, এখন চায়ের দরকার নেই। চলো দুজনে ঘুরে আসি। রাস্তার ধারে মকবুল মিয়ার দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাব। যাবে?
হ্যাঁ যাব। ওই চা খেতে ভীষণ মজা পাই।
মজা কেন?
ওরা যেভাবে চায়ের পাতা সেদ্ধ করে চা বানায় সেটাই আমার মজা। আমরা তো ওভাবে চা বানাতে পারি না।
হাসতে হাসতে তারেক বলে, তাহলে চলো যাই।
একটু অপেক্ষা করো। হাতের কাজটুকু সারি।
বেশি দেরি করা চলবে না কিন্তু।
একদমই না। আসছি।
তার একটুক্ষণ আগে তন্ময় নেমেছে ট্রেন থেকে।
ওর কেমন অচেনা লাগে ফুলসি স্টেশনকে, কোথায় যেন কী ঘটেছে–দারুণ আকাল চারদিকে এই দুর্ভিক্ষপূর্ণ এলাকাটি ওকে মর্মাহত করে। নাকি বিদেশ থেকে ঘুরে আসার কারণে এই অখ্যাত স্টেশনটি ওকে টানতে পারছে না! নাকি এখানে কোনো বিপর্যয় ঘটেছে? তন্ময় নিজেকে প্রশ্ন করে কিন্তু বুকের ভেতরে উত্তর পায় না। ট্রেন থেকে এখানে নামার পরেই বুকের ওই জায়গাটা অসার হয়ে আছে।
আর দূর থেকে তন্ময়কে দেখে মাসুমের হাত থেকে সবুজ পতাকাটা পড়ে যায়। ও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পতাকাটা ওঠাতেও মনে থাকে না। ট্রেন চলে গেছে। যাত্রীরাও কেউ নেই। তন্ময় ওকে দেখে এগিয়ে আসে। ও পতাকাটা উঠিয়ে মাসুমের হাতে দিয়ে বলে, কেমন আছ মাসুম?
আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন তন্ময় ভাই?
আমার কি থাকার জায়গার অভাব? যেখানেই যাই সেখানেই ঠাঁই।
মাসুমের হাঁ করে তাকিয়ে থাকা দেখে বলে, কী হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? মনে হচ্ছে তোমার খুব কষ্ট।
মাসুম আস্তে করে বলে, তাহেরা চাচি মারা গেছে।
কবে?
দুদিন আগে। আমি নিজের হাতে কবরে নামিয়েছি।
ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে ও বাড়িতে যাব। ফজর আলি আর হনুফাঁকে ছবি দিয়ে আসব। অনিমা কেমন আছে মাসুম?
জানি না।
জানো না? সেজন্য তুমি অনিমার কথাই বলছ না। বেশ মজার ছেলে তুমি! মাস্টার সাহেব অফিসে আছেন?
না বাড়িতে।
তাহলে চলো আমরাও বাড়িতে যাই। তোমার সঙ্গে কথা বলে কতটা সময় পার করে দিলাম।
আপনি যান, আমার কাজ আছে। আর দশ মিনিটের মধ্যে উল্টো দিক থেকে আর একটা ট্রেন আসবে।
মাসুমের কথাগুলো খুব কাটা কাটা মনে হয়। তন্ময়ের কানে খট করে বাজে। তারপরও ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, বুঝতে পারছি কোনো কারণে তোমার মুড অফ। যাকগে আমি যাই।
প্লাটফর্ম পার হতেই কাগজের ফুল-পাতায় সাজানো বাড়িটা ওর চোখে পড়ে। তন্ময় থমকে দাঁড়ায়। মনে হয় কাগজগুলো ম্যাথুর টেবিলে রাখা রঙিন পাথর। বর্ণিল দ্যুতিতে ফুলৰ্মসি স্টেশনে অদ্ভুত আলো ছড়িয়েছে। তাহলে কিছুক্ষণ আগেও কেন জায়গাটিকে দুর্ভিক্ষপূর্ণ মনে হয়েছিল ওর? তন্ময় ফিরে আসে মাসুমের কাছে।
অনিমাদের বাড়িটা অমন সাজানো কেন মাসুম?