গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিকটা কি লাগাব?
দরকার নেই।
সন্ধ্যায় যখন সাজি তখন ওই লিপস্টিকটা লাগাই। সারা রাতের কাস্টমাররা শুষে নিয়েছে।
তুমি এখানে দাঁড়াও।
ক্লান্ত, বিষণ্ণ মেয়েটির চোখজোড়ায় যেন পরাজিত মানুষের ছায়া। তন্ময় শিহরিত হয়। এমন চোখ ও আগে দেখেনি। ছবি তোলা হলে টাকা দিতে দিতে বলে, তোমার নাম কী?
আমার তো অনেক নাম। কাস্টমাররাই নাম দেয়। মায়ের রাখা নাম আমার মনে নেই। আপনিও আমাকে একটা নাম দিতে পারেন। আপনিও তো আমার কাস্টমার।
কাস্টমার? তন্ময়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
মেয়েটি খিলখিল হাসিতে দিনের প্রথম আলো ভরিয়ে দেয়। বলে, কাস্টমার না হলে টাকা দিলেন কেন? আমরা তো পোলাও খাই, আবার মুড়িও খাই। সব খাওয়া কি একরকম!
আশ্চর্য! তন্ময় হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, কত বয়স হয়েছে ওর? মেয়েটি খিলখিল হাসি হেসে বলে, আপনি এখানে এলে আমাকে পাবেন। আমি এই এলাকার চারপাশেই থাকি। আসবেন কিন্তু, এই সময়ে। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব।
অপেক্ষায়! তন্ময়ের মাথা বনবন করে। দেখতে পায় মেয়েটি উল্টো দিকের ফুটপাথে উঠে চলে যাচ্ছে। ওর ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে বলে আসতে, আমার অপেক্ষায় তুমি থেকো না। তোমার সঙ্গে আমার আর কোনো দিন দেখা হবে না। কিন্তু কী লাভ? এটাই বোধহয় ওর উপার্জনের ভাষা। ও সবাইকে এভাবেই বলে হয়তো। নিজেকে যুক্তি দেখিয়ে খানিকটুকু সান্ত্বনা খোঁজে তন্ময়।
দুদিন পর ঢাকায় ফিরে মাকে ঘটনাটা বলে ও। সাবিহা বানু এক। মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, সখিনাকে তুই আমার কাছে নিয়ে না এলে ও হয়তো এভাবে নিজের জায়গা খুঁজে নিত সোনা।
তন্ময় চেঁচিয়ে বলে, তুমি আমার কথা বললে না কেন? আমিও তো…
চুপ কর, চুপ কর বলছি। তুই শুধু আমার ছেলে, শুধু আমার।
সাবিহা বানু হিংস্র কণ্ঠে কথা বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তন্ময় মাকে জড়িয়ে ধরে কোলে মুখ গুঁজলে ওর মনে হয় একটি বিশাল সত্য প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে দুজনের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে–দুজনকেই এই সত্য কুরে খায়। কখনো সেটা সামনে আসে, কখনো অদৃশ্য থাকে–তারপরও সম্পর্কের সুষম টানের ফাঁক গলিয়ে সেই সত্য নাক গলায়। উপায়হীন জীবনের নির্মম কষ্ট।
অনিমার সামনে এখন অসীম শূন্যতা। চারদিক থেকে ওকে ঘিরে ধরা হয়েছে–বড় বাধা বাবা, সেই সঙ্গে বাবার ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, ভবিষ্যৎ চিন্তা এবং মেয়ের নিরাপদ জীবন দেখার তীব্র বাসনা ওকে দমিয়ে রাখে। এই বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে আসার ওর কোনো উপায় নেই। ও সব কিছু বাদ দিয়ে তো ‘আমি’ হতে শেখেনি। ও বাবাকে অস্বীকার করবে কীভাবে? অনিমার দিনগুলোতে অন্ধকার ভরে থাকে। এরপরও স্টেশনে ট্রেন এলে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। না, তন্ময় নামে না। দুদিনের মাথায় দেখতে পায় সাদেক আলী ও তার ছেলে তারেক ট্রেন থেকে নামছে। অনিমা বুঝে যায় বাবা আর অপেক্ষা করবে না। সবই গুছিয়ে ফেলেছে। তার চাচাতো ভাই আর ভাইয়ের। ছেলেকে আনিয়েছে। ও ছুটে ভেতরে আসে। পাখি বানিয়ে রাখা চিঠির ব্যাগটা টান দিয়ে নামিয়ে ঘরময় উড়িয়ে দেয়–কত দিকে গড়িয়ে যায় পাখিগুলো। ও চৌকিতে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে থাকে। ওর শরীর হিম হতে থাকে, এক সময় ওর মনে হয় ওর ঘুম পাচ্ছে–ও একগাদা কাগজের পাখি বুকে জড়িয়ে চৌকির সঙ্গে মাথা হেলায়।
অতিথি নিয়ে বাড়ি এসে তৌফিক অনিমাকে এই অবস্থায় দেখে আঁতকে ওঠে। ওর কাছে উবু হয়ে বসে আস্তে করে ডাকে, মা। অনিমা ঘোলা চোখে বাবাকে দেখে।
কী হয়েছে মা?
কিছু তো হয়নি বাবা।
তুই ভালো আছিস তো মা?
ভালো তো আছি।
ইয়ে মানে–ওরা এসেছে–তুই—
আমাকে নিয়ে তুমি কিছু ভেব না বাবা। তুমি আমাকে কত ভালোবাসো–তোমার ঋণ কি আমি শোধ করতে পারি! বাবা আমাকে দিয়ে তোমার কোনো অবমানো হবে না।
সত্যি বলছিস মা?
হ্যাঁ বাবা।
তৌফিক খুশি মনে উঠে যায়। অনিমা শুনতে পায় ওর বাবা সাদেক আর তারেকের সঙ্গে উঁচু স্বরে কথা বলছে। ও বুকের সঙ্গে খুঁতনি ঠেকিয়ে বলে, ভালোবাসাহীন জীবনের একটি বিয়ে, পুরো জীবনের আর কতটুকু খাবে? দেখতে হবে আর একটি ভালোবাসার অপেক্ষায় জিততে পারে কি-না। এ অপেক্ষা তারেককে নিয়ে। এভাবে বেশ ভালোই একটি সময় গেল। সামনে কী আছে অনিমা জানে না–ও জানার জন্য ভাবতে চায় না, ওর মাথা ভার হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে বুকের ভেতরের সব জায়গাটুকু জুড়ে নুড়ি বিছানো। কখনো সেসব নুড়ি আশ্চর্য ধ্বনিতে টুংটুং করে–ওর কিছু করার নেই, শুধুই কান পেতে থাকে। অনিমা নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে।
দুদিন পরে বিয়ে।
রঙিন কাগজে দিয়ে স্টেশন মাস্টারের বাড়ি সাজানো হয়েছে। অনিমার ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে মাসুম। মনের সুখে ওরা রঙিন কাগজ কেটে ফুল বানাচ্ছে, নৌকা, পাখি, হাতি, ঘোড়া নানা কিছু বানাতে চাইছে। কখনো ঠিকমতো হয়, কখনো হয় না–তাতে কি, পুরো বাড়ির দেয়াল ভরে যাচ্ছে সেসব নকশায়। মাসুম মাঝে মাঝে অনিমার সামনে এসে দাঁড়ায়–কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারে না। আসলে ওর বলারও কিছু নেই। মানুষটি যে এখান থেকে গেল আর কোনো খবর নেই। ঠোঁট উল্টে বলে, এমন ভবঘুরে মানুষের সঙ্গে আপার বিয়ে না হওয়াটাই ভালো। কোন দিন আবার আপাকে রেখে কোথায় উড়ে যাবে, কে জানে! ভালোই হয়েছে। ও ছেলেমেয়েদের তাগাদা দিয়ে জিঞ্জির বানানো শেষ করে। গেটের উপর ওটা ঝোলাতে গিয়ে আকস্মিকভাবে ওর খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ওর দুচোখ ভেসে যায় জলে।