চলো যাই।
অবনীশ স্থলিত কণ্ঠে বলে, ট্রেঞ্জ।
তন্ময় ওর দিকে তাকায় না জানে ওর অভিব্যক্তি এমনই–যে কেউই চট করে বলতে পারবে না যে ওর ভেতরে কোথায় কী তোলপাড় হচ্ছে।
০৬. বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকার আগে
বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকার আগে ওরা ওকে বিদায় জানায়। এ সীমানার পরে ওরা আর যেতেও পারবে না। বলে, আবার দেখা হবে তোমাদের সঙ্গে।
অবনীশ হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ, কোথাও না কোথাও তো হবেই। পৃথিবীটা খুবই ছোট।
তোমারও কি তাই মনে হয় দময়ন্তী?
হয়ই তো। অবনীশ বলেছে বলে নয়, আমিও এটা বিশ্বাস করি। নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।
তাই যেন হয়। আসি।
দময়ন্তী ওকে জড়িয়ে ধরে–অবনীশ হাত মেলায়। মৃদুস্বরে বলে, ভালো থাকবে।
তন্ময় ট্রলি ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়। পেছনে তাকায় না—এটা ওর অভ্যেস নয়–ওর মনে হয় ওরা দাঁড়িয়ে আছে–আবার দেখা হবে এই বিশ্বাস ওর নিজেরও আছে–ও অভ্যেস ভেঙে পেছন ফিরে তাকায়–দেখে ওরা দাঁড়িয়ে আছে–ওকে হাত নেড়ে বিদায় দেয়।
প্লেনে বসে তন্ময়ের মনে হয় ই-মেইলে বন্ধু হওয়া দময়ন্তী কিংবা লন্ডনে দেখে আসা নীলিমা, মাধবী, জুলিয়ানার সঙ্গে অনিমার কোনো মিল নেই। অনিমা এদের মতো করে এখন পর্যন্ত জীবনকে দেখেছে বলে ওর মনে হয় না। তাহলে অনিমা কি বিয়ের পরে জীবনকে নতুন করে দেখতে শিখবে? নাকি ও নিজের সঙ্গে কোনো যুদ্ধ না করে পরিস্থিতি মেনে নিয়ে জীবন কাটাবে? কোনটা হবে অনিমার ঠিকানা? শান্ত, নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ পরিবেশে বড় হওয়া অনিমার আসলে জীবনকে দেখাই হয়নি। এইসব নারীর ভাবনা অনিমার জীবনে শক্ত অবস্থান তৈরি। করেনি। তন্ময় সিটের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ভাবে, অনিমার কী আছে এখনও ওর জন্য অপেক্ষা করে? মুহূর্তে ধড়মড় করে আবার সোজা হয়ে বসে। বিচলিত বোধ করে। আতঙ্কিত হয়। পাশের সিটের ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলে, কিছু হয়েছে?
নো। থ্যাঙ্কস।
তন্ময় নিজের উৎকণ্ঠায় বিব্রত বোধ করে। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এয়ারহোস্টেসকে বলে, আমাকে একটু পানি দেবেন? ওর মনে হচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ও যেন নতুন অনিমাকে দেখতে পাচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে এটাও অবে, অনিমা যদি বদলে যায় তাহলে ও। অনিমাকে বোঝার মতো অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছে। এটাকে কি ও জ্ঞান বলবে? হ্যাঁ, জ্ঞানও বলা যায়। অবশ্যই ও জ্ঞান লাভ করেছে, শিখেছে। এটা ভাবতেই ওর মাথা হালকা হয়ে যায়। ও নড়েচড়ে বসে। উইনডো সিটটা পেয়েছে বলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে নীলিমা দেখে। আবার মন খারাপ হয়ে যায়। অনিমা কি ওর ওপর আস্থা রাখতে পেরেছে? ওর লেখা একটা চিঠিও কি অনিমা পেয়েছে? নীলিমাজুড়ে অনিমার মুখ ভেসে ওঠে। মনে হয়, ও একটি অন্যরকম মেয়ে, মাধবী বা নীলিমার মতো জীবনের শিক্ষা না থাকলেও ও নিশ্চয় পরাভূত হবার নয়। তন্ময় আবার আশ্বস্ত হবার চেষ্টায় সিটের গায়ে হেলান দেয়। পাশের যাত্রীটি আবার বলে, কিছু হয়েছে?
না তো! আমি ঠিক আছি।
এতক্ষণে পাশের যাত্রীটির ওপর ও বিরক্ত হয়। তবে রাগতে পারে। পরক্ষণে নিজেকে শাসায়। ও তো অস্থিরতা দমাতে পারছে না এবং তা কোনো না কোনোভাবে ওর আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। পাশের যাত্রীটি নিঃসন্দেহে একজন তীক্ষ্মধী ব্যক্তি–সরাসরি ওর মুখের দিকে না। তাকিয়ে ঠিকই ওর অস্থিরতা অনুভব করতে পারছে। তিনি কি একজন মনস্তাত্ত্বিক, নাকি লেখক? ও ওর ভাবনায় নিচুপ হয়ে যায়।
প্লেন ল্যান্ড করার আগে পাশের যাত্রী ওকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি দিল্লিতে থাকেন?
না, ঢাকায়। একটা ওয়ার্কশপ অ্যাটেন্ড করব।
কত দিনের?
দিন পনেরো।
দ্রলোক তার কার্ড দিয়ে বলে, সময় পেলে আসবেন।
তন্ময় তাকিয়ে দেখে, তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। চেম্বারের ঠিকানা আছে। ও মৃদু হেসে বলে, থ্যাঙ্কু। প্লেন ততক্ষণ মাটি ছুঁয়েছে। রানওয়েতে দৌড়ে যাচ্ছে। সিট বেল্ট খোলার শব্দ উঠেছে, প্লেন থেমে গেলে সবাই মাথার ওপরের লকার থেকে ছোটখাটো ব্যাগগুলো নামায়। ভদ্রলোক পায়ের কাছে রাখা নিজের ব্যাগটি তুলে নিয়ে বলে, আসি।
তন্ময় ঘাড় নাড়ায়। ও জানে তার দেয়া কার্ড ওর কোনো কাজে আসবে না। ওর মানসিক অবস্থা এখনো সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ও ধীরেসুস্থে নামার জন্য অপেক্ষা করে এবং শেষ পর্যন্ত এয়ারক্র্যাফটের শেষ যাত্রী হয়ে সিড়িতে পা রাখে।
দিল্লিতে কয়েকটা দিন ওর হাওয়ার বেগে উড়ে যায়। ওয়ার্কশপের পাশাপাশি নতুন দিল্লি, পুরনো দিল্লি মিলিয়ে পাঁচশ ছবি তোলে। সবচেয়ে অবাক হয় সড়ক দ্বীপে চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা নতুন দিল্লিতে বাসকারী গৃহহীন মানুষদের ছবি তুলে। ভাবে, দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষবিন্দুতে অবস্থানকারী দেশের রাজধানীর প্রথম আলোর সকাল এমনই! মানুষকে ভাত ও গৃহ দেয়ার বদলে প্রতিযোগিতা করে অস্ত্র ও বোমার পাল্লায়। কে ঠেকাবে কাকে!
ক্যামেরা ব্যাগে ঢোকানোর সময় রাতের উপার্জনকারী একটি কিশোরী কাছে এসে বলে, আমার একটা ছবি তুলবেন?
তুলতে পারি, কিন্তু ছবি তো তোমাকে দিতে পারব না।
আমি তো ছবি চাই না।
তাহলে কী চাও?
টাকা। বিশ টাকা দিলেই হবে।
তোমার ছবি দিয়ে আমি কী করব?
উপার্জন করবেন।
উপার্জন?
হ্যাঁ, দিল্লির একটি মেয়ে যে শরীর বিক্রি করে তার ছবি পত্রিকায় দিতে পারবেন, এক্সিবিশন করতে পারবেন, এমনই। আপনিও টাকা পাবেন।
টাকা আমি পাব কি-না জানি না। তবে তোমার একটি ছবি আমি তুলব।