দময়ন্তী বলে, কেমন দোকানটা?
সুন্দর।
কিনবে কিছু?
হ্যাঁ, একটা মুখোশ।
পছন্দ করো।
একটি চিকন লম্বা কাঠের ওপর সারি করে লাগানো ঘোট ঘোট বারোটা মুখোশের একটি পিস ও কেনে। দময়ন্তীকে বলে, এটা দিল্লি হয়ে ঢাকা পর্যন্ত যাবে তো? নাকি টুকরো হয়ে যাবে?
তুমি কীভাবে নেবে তা তোমার ওপর নির্ভর করবে।
তোমার কোনো কায়দা জানা নেই?
আমি দোকানদারকে বলছি ভালো করে প্যাক করে দেয়ার জন্য।
এটা যদি ভেঙে যায় তুমি কিন্তু আমাকে আর একটি কিনে পাঠিও।
পাঠাব। এটা কোনো কঠিন কাজ নয়। আমার মনে হয়েছিল তুমি এমন জিনিসই বেশি পছন্দ করবে।
থ্যাঙ্কু। তন্ময় গম্ভীর হয়ে ওকে ধন্যবাদ জানায়। যেন ওর কাছ থেকে জিনিসটি পেয়েছে এমন ভাব দেখায়। দময়ন্তী সেটি খেয়াল না করেই খুশি হয়। বলে, চলো শাড়ি দেখবে। এখানে বেশ কয়েকটা শাড়ির দোকান আছে, অনিমার জন্য কিনতে পারো।
চলো দেখি। কী ধরনের শাড়ি আছে।
বুটিক শপ দেখতে পারো। সুচের কাজ করা শাড়িও তোমার পছন্দ হবে আমার বিশ্বাস।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি আমার নাড়ি-নক্ষত্র সবকিছু জেনে বসে আছ। মায়ের জন্য শাড়ি কিনব না?
চলো, শাড়ি দেখার আগে চা খাই।
ছোট্ট একটি চায়ের দোকান–পরিচ্ছন্ন–দু’জনে বেশ আমুদে মেজাজে চেয়ার টেনে বসে–ওখানে বসেই দেখা যায় সামনের গোল চত্বর–মাঝখানে মঞ্চ আছে খোলা মঞ্চ–চারপাশে ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আছে–গানের প্রবল শব্দে তন্ময়ের কানে তালা লাগার উপক্রম–কিন্তু পপ গানের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের অনেকে নাচছে–তারুণ্যের উদ্দীপনা দেখতে বেশ লাগে।
ওদেরকে চা সার্ভ করার আগেই একজন ঢোকে–তাকে দেখে দময়ন্তী মৃদু হেসে বলে, এসো। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার বন্ধু অবনীশ। এ সময়ে আমি ওকে এখানে আসতে বলেছিলাম তোমার সঙ্গে পরিচয় করে দেব বলে।
কেমন লাগল দময়ন্তীকে?
অবনীশ মৃদু হেসে বলে।
কেন এমন প্রশ্ন করলেন?
আপনাদের ই-মেইলে বন্ধুত্ব। কেউ কাউকে তো আগে দেখেননি, তাই।
আপনার কেমন লাগে দময়ন্তীকে?
একজন বন্ধুকে যেমন লাগা উচিত তেমন। নিশ্চয় ভালো লাগে, নইলে তো বন্ধুত্ব টিকত না।
বেয়ারা চা দিয়ে যায়। দময়ন্তী আর এক কাপ দিতে বলে। অবনীশ তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, স্যান্ডউইচের অর্ডার দেই?
আমি খেতে পারব না। দুপুরে গাদা গাদা খাওয়া হয়ে গেছে।
দময়ন্তী দারুণ হোস্ট।
বুঝেছি আপনার অভিজ্ঞতা বেশ কড়কড়ে। আপনি ভীষণভাবে আপ্যায়িত হন ওর বাড়িতে, না?
অবনীশ স্মার্টলি বলে, তা হই। স্বীকার করতে কোনো সংকোচ নেই।
তন্ময় পূর্ণ দৃষ্টিতে অবনীশকে দেখে–বেশ লাগে দেখতে–যেমন হলে নারীরা প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয় তেমন চেহারা–নিজেই খানিকটা দুর্বলতা অনুভব করে এবং একই সঙ্গে লজ্জিত নিজেকে বকা দেয় এই ভেবে যে, লাটাইয়ের সুতো ছাড়ার সীমা থাকা উচিত–ও সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
অবনীশ কণ্ঠে কৌতুক নিয়ে বলে, কিছু ভাবছেন?
ও সপ্রতিভভাবে বলে, হ্যাঁ।
কী? অবনীশের কণ্ঠ বেশ ভারী।
ও চুপ করে থাকে–চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দেয়–বেশ স্বস্তি হয়–অবনীশের দিকে তাকায় এবং মুগ্ধতা প্রকাশে দ্বিধা করে না।
আপনার ভাবনার কথা বললেন না?
আপনি কি আমাকে পৌঁছে দিতে এয়ারপোর্টে যাবেন?
সেজন্যই তো এখানে জড়ো হয়েছি। দময়ন্তীর হুকুম।
তাই তো, ও মিনমিন করে।
দময়ন্তী আর অবনীশ হো-হো করে হাসে–ওর ভীষণ ক্রোধ হয়–কিন্তু প্রবলভাবে নিজেকে সংযত রাখে, মনে হয় ও দময়ন্তীকে বোকা-গাছা ভেবেছে–আসলে গাধা ও নিজেই–কারো কারো ছদ্ম আবরণ খুলতে সময় লাগে। দময়ন্তী ছদ্ম আবরণে ঢাকা নারী–ওর কাছে অস্পষ্ট এবং রহস্যময়ী। ও আকস্মিকভাবে বলে, আমার এখন এয়ারপোর্টে চলে যাওয়া উচিত।
তুমি এখনো অনায়াসে আমাদের সঙ্গে আরো এক ঘণ্টা কাটাতে পারো।
বিমানবন্দরে যাই–আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে অনেক সময় বেশ সময় লেগে যায়।
আপনার আর আমাদের সঙ্গ ভালো লাগছে না?
অবনীশ বাঁকা চোখে তাকায়।
আপনি বিগড়ে গেলেন কেন বলুন তো?
বিগড়াইনি তো।
বিগড়াচ্ছ কি না জানি না। তবে তোমার মুড অফ হয়ে গেছে। যাকগে, চলো যাই। ওঠো অবনীশ। তবে মনে রেখো ঢাকায় গেলে আমি আর অবনীশ একসঙ্গে যাব। একই রুমে থাকতে দিও কিন্তু।
থাকবে। তার জন্য আবার অনুরোধ করছ কেন?
শহরটা তো অচেনা।
তাতে কী? তুমি তো জনে জনে বলে বেড়াবে না যে তুমি আর অবনীশ বন্ধু।
যদি বলি?
তাতে অসুবিধে হবে না। বলেছি না ডাস্টবিন। এখানেও নানা কিছু চলে। তোমাদের ভয় নেই অবনীশ এবং দময়ন্তী।
তন্ময় হো-হো করে হাসে–হেসে উড়িয়ে দেয় নিজের ভেতরের নানা অর্বাচীন চিন্তা–এই তো মাত্র গতকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে জবাই করে ফেলে রেখে গেল ধর্ষকরা–বিশ্ববিদ্যালয়ের মালি ওর বাঁচাও বাঁচাও ডাক শুনে তিন দিন পরে ঘন গাছপালার ভেতর থেকে উঠিয়ে এনে হাসপাতালে ভর্তি করে–ধর্ষিত, গলাকাটা মেয়েটি কীভাবে এ ক’দিন বেঁচে ছিল এটা একটি প্রচণ্ড বিস্ময়–ওই অবস্থায় মেয়েটি ধর্ষকদের বিচার চেয়েছে–বিচারের আশায় ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে–ও এখন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছে।
বিচার! ডাস্টবিনের ভেতরে বাস করা মানুষেরা এভাবেই খুন হয় এবং বিচার পাওয়া কঠিন–প্রায়শ হয়ই না–যে শহরে ওর প্রতিদিনের জীবনযাপন করা–যেখানে বিচার সাধারণ মানুষের বাইরে–যেখানে ধর্ষকরা ক্রমাগত আইনের বাইরে থাকে–সেখানে অবনীশ এবং দময়ন্তী তো মিউচুয়ালি একসঙ্গে একঘরে থাকবে–তারা তো পরস্পরের দায় নিয়ে থাকবে–তার সঙ্গে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই–তবে কেন ও ওই গার্মেন্টস কারখানার মেয়েটিকে মাথায় নিয়ে দিল্লিতে যাচ্ছে–কারণ দিল্লির শান্তি-সংগঠকরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে–তাদের শান্তি-ভাবনা নারীর জীবন থেকে ছুটে যায়–তারা কোনো দিনই খুঁজে পাবে না সেই গলাকাটা মেয়েটিকে যে বেঁচে থাকার শেষ মুহূর্তে বিচার চেয়েছে। তন্ময় সে কথা ওদের না বলে ওঠার তাড়া দেয়।