তন্ময় গোপালের দেয়া আচার তর্জনি দিয়ে চেটে খায়। মিষ্টি আমের। আচার–চমৎকার বানিয়েছে। জিজ্ঞেস করে, এই তিন বছরে দেশে যাসনি?
না। বোনরা যেতে দেয় না। ওদের ধারণা, আমি গেলে সন্ত্রাসীরা আমাকে মেরে ফেলবে।
যাসনি ভালো করেছিস। ডাস্টবিন থেকে বেরিয়েছিস ঠিক করেছিস।
গোপাল চোখ মুছে বলে, আমার দেশে ফিরতে খুব ইচ্ছে হয়। এখানে আমার পরান টিকে না। আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর। এসএসসি পাস করে যে পড়তে পারলাম না এজন্য খুব কষ্ট হয়। স্কুলে আমি জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ খুব ভালো গাইতে পারতাম। সব অনুষ্ঠানে–
ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে গোপাল। কাউন্টারে বসে থাকা ম্যানেজার ছুটে আসে।
ছেলেটা যখন-তখন দেশের কথা মনে করবে আর কাঁদবে। ওকে আমি ফেলতেও পারছি না, গিলতেও পারছি না! আপনি বুঝি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? দেশের লোক দেখলে ওর দুঃখ আরো বেড়ে যায়।
তন্ময় ক্রুদ্ধ কঠে মুখ ভেংচিয়ে বলে, দুঃখ আরো বেড়ে যায়–ন্যাকামি–দুবোন ধর্ষিত হয়েছে, তাতেও হুঁশ হয় না।
হবে কেন? ও তো আপনের চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক। আয় গোপাল।
দুজনে হনহনিয়ে চলে যায়।
দময়ন্তী অসন্তুষ্ট চোখে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, হলো তো ভালো শিক্ষা পেয়েছ–ওরা কি তোমার তিক্ততা বুঝতে পারবে–আমার সঙ্গে রাগ ঝাড়ছ ঝড়ো–সবখানে ঝেড়ো না–সবার মাথা সূক্ষ্ম নয়।
দময়ন্তী, চলো অন্য কোথাও যাই। কোথায় যাবে?
রাত সাড়ে আটটায় আমার ফ্লাইট–এখনো অনেক সময় হাতে আছে।
চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই–সেখানে গেলে এক জায়গায় অনেক কিছু দেখতে পারবে।
ওরা যখন রেস্তোরাঁ থেকে বের হয় তখন গোপাল এসে সামনে দাঁড়ায়–তন্ময় আগেই দময়ন্তীর কাছ থেকে কয়েকটা টাকা নিয়েছিল ওকে দেবে বলে–টাকাগুলো ওর পকেটে দিয়ে দেয়–ভালো থাকিস গোপাল–অনেক ভালো, খুব ভালো–
দেশ ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারি না–বিদেশে বেশি দিন থাকলে আমার পরান পোড়ে–
আবার ওর চোখ জলে ভরে যায়–ওর জন্য তন্ময়ের ভীষণ মায়া হয়।
দময়ন্তী মৃদুস্বরে বলে, তোমাদের দুজনের দুরকম এক্সপ্রেশন–আমার বেশ অভিজ্ঞতা হলো–আমি ভুলব না–গোপাল তোমার মতো বোঝে না বলে রাগে না–কেঁদে ভাসায়–তুমি অনেক কিছু বোঝ বলে রাগ ঝাড়ো।
তোমার এমন পরিস্থিতি হলে তুমি কী করতে?
আমি দুটোই করতাম। কখনো রেগে যেতাম, কখনো কেঁদে ভাসাতাম।
তন্ময় হা-হা করে হেসে বলে, আমিও তাই করি–তোমাকে পেয়ে আমার মনে হয়েছে তুমি আমার রাগ ঝাড়ার জায়গা–চলো কোথায় যাবে বলছিলে।
দময়ন্তী গাড়ি ড্রাইভ করে–পথের দুপাশে বাড়িঘর, মানুষ ছুটে চলার প্রচণ্ড গতি–অকস্মাৎ ও সব কিছু থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে–ওর বমি পায়–কান্না পায়–ওর মাথায় বিতৃষ্ণার ঘূর্ণি জন্মায়–কলকাতা শহর দেখবে না বলে চোখ বোজে।
তোমার খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ। তন্ময় ক্লান্ত কণ্ঠে বলে।
রেস্ট করবে? ঘুমুতে চাও?
ধুত বাজে বকো না। কোথায় যাচ্ছিলে যাও।
তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা–অথচ তুমি এমন ঢঙে কথা বলছ যেন আমাদের হাজার বছরের পরিচয়।
তন্ময় শব্দ করে হাসতে থাকে–ওর কথার উত্তরে কিছু বলে না–ছোটখাটো মটুসটু দময়ন্তী একা থাকে–ওর বেশ কয়েকজন ছেলে বন্ধু আছে–ওদের সঙ্গে আড্ডা হয়–কারও সঙ্গে রাতও কাটায়–কিন্তু ওকে তন্ময়ের ভীষণ বোকা মনে হয়–খানিকটা গ্রাম্যও–যে সূক্ষ্মতা থাকলে কাউকে ও নিজের বিচারের মাত্রার উপরে ওঠাতে পারে দময়ন্তী তেমন নয়–মাত্রার নিচে আধুনিকতার ভান আছে–কিন্তু বোঝে না–তবে ওর সঙ্গে ঘুরে কখনো ওর সরল মাধুর্য ওকে আকৃষ্ট করে। ও অসম বয়সের বন্ধুত্ব উপভোগ করে। এত চিঠি লেখালেখি হয়েছে যে মনেই হয় না এই প্রথম দেখা! শুরু থেকেই চেনা মানুষের মতো আচরণ করছে।
ও তন্ময়কে একটি জায়গায় নিয়ে যায়–কী যেন একটা নাম বলে তা ওর মনে থাকে না–তবে এখানে বিচিত্র জিনিসের সমাহার আছে–পেইন্টিং গ্যালারি–আকারে ছোট–কিন্তু পুরনো পেইন্টিংগুলো অ্যান্টিকের মতো—-কোনোটা আকারে বেশ বড়, নতুন-পুরনো মিলিয়ে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা ছবিগুলো অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দেখে ও–বাইরে চনমনে দুপুর–ভেতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ–বসার জায়গা আছে–চেয়ারগুলোরও অ্যান্টিক চরিত্র–পরিচ্ছন্ন-রুচিশীল। ও দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলে, থ্যা দময়ন্তী।
হঠাৎ থ্যাঙ্কু? ও ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
জায়গাটা দারুণ।
যাক তবু একটু প্রশংসা পেলাম। তোমার ই-মেইল পাওয়ার পর থেকেই ঠিক করেছিলাম তোমাকে এখানে নিয়ে আসব।
তুমি সরাসরি এখানে চলে এলেই পারতে। ভাত খাওয়ার দরকার ছিল না।
হো-হো করে হাসে দময়ন্তী–ওকে বেশ আত্মতৃপ্ত দেখায়–এটুকুই ওর গ্রাম্যতা, ওর গ্রাম্যতায় ও বিরক্ত হয়–ওর হাসির শব্দও শুনতে চায় না–বরং গণেশ পাইনের আঁকা বড় ছবিটার সামনে গভীর মনোযোগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে–দারুণ এঁকেছে–একসঙ্গে অনেক মানুষ–একটি গ্রামের হাট–কিন্তু প্রতিটি ফিগারের আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য আর রঙের সংবেদনশীল ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই–অনেকক্ষণ পর যখন গ্যালারি থেকে বের হয় তখন ভাবে কতবার কলকাতা এলো অথচ কারো কাছেই এই জায়গার কথা শোনেনি–দময়ন্তীর নির্বাচনে ওকে আধুনিক মানুষের খানিকটুকু প্রশংসা দেয়–কিন্তু মুখে আর কিছু বলে না–পাছে ওই উদ্ভট হাসি শুনতে হয়।
জায়গাটার কোনো এক দিক থেকে পপ সংগীতের সুর ভেসে আসছে–সঙ্গে ড্রামের শব্দ–ও নয়েজ পলিউশনে আক্রান্ত মানুষ–তারস্বরে ভেসে আসা কণ্ঠ এবং বাজনার শব্দ ওকে অস্থির করে তোলে–কিন্তু দময়ন্তীকে সে কথা বলার আগে ও তন্ময়কে নিয়ে ছোট একটি দোকানে ঢোকে–মুখোশ, টেরাকোটার খণ্ড, মাটি ও পেতলের মূর্তি, নানা ধরনের ধাতুর গয়না, ছোট আকারের পুরনো পেইন্টিং–কিছু বই ইত্যাদি দিয়ে সাজানো দোকান–বেশ চমৎকার–এমন একটি দোকান ঢাকায় আছে কি না ও জানে না–থাকতেও পারে–পৃথিবীর সব খবর ওর নখদর্পণে থাকবে এটা ভাবার কারণ নেই।