এই পর্যন্ত বলে তন্ময় চুপ করে যায়। গ্লাসে পানি রেখে গেছে বেয়ারা। ঢকঢকিয়ে এক গ্লাস পানি খায়। টিস্যু দিয়ে মুখ মোছে। দময়ন্তীকে বলে, খাবারের অর্ডার দাও। ও উত্তর দেয় না। আশপাশের টেবিলের লোকেরা ওর দিকে তাকিয়েই আছে। কেউ ভাত খাওয়ায় মনোযোগী নয়। ও বুঝতে পারে যে ওরা পরেরটুকু শুনতে চায়। তখন কাছে দাঁড়িয়ে থাকা রেস্তোরাঁর কিশোর বয়টি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটি কী করল?
রাতে কীটনাশক পান করল। আশপাশের লোকজন হুড়োহুড়ি করে। হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার জানা মরে গেছে।
ছেলেটি দু-হাতে চোখের জল মুছে বলল, আমার বাড়ি সাতক্ষীরায়। আমার নাম গোপাল।
ও তুইও সেই ডাস্টবিন থেকে উঠে এসেছিস গোপাল?
ডাস্টবিন!
চারপাশে গুঞ্জন ওঠে–মানুষেরা পরস্পরের দিকে তাকায়–কেউ ভাত খাওয়ায় মনোযোগী হয়–যাদের খাওয়া শেষ হয়েছে তারা উঠে পড়ে–কেউ বিল দেয়ার জন্য কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে–দময়ন্তী কড়া স্বরে বলে, তুমি এত অসহিষ্ণু কেন? তোমার চিঠি পড়ে এমন মনে হয়নি–চিঠি পড়ে মনে হতো তুমি শান্ত, ধীরস্থির, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।
তন্ময় দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে–রাস্তায় গাড়ি-ট্রাক লোক চলাচল দেখে–মানুষের মুখচ্ছবিতে স্বদেশের চিত্র ফোটে না–মানুষ বিষণ্ণ এবং ক্লান্ত–গুটি কয়েক ক্ষমতাবান মানুষের হাতে কোটি কোটি মানুষ জিম্মি–মানুষের জীবনের জন্য তাদের কোনো তোয়াক্কা নেই–নিজেদের পকেট বোঝাই হলেই হলো–সেটা ডোনারের টাকাই হোক বা বিদেশ থেকে আসা রিলিফের সামগ্রীই হোক–ওদের ধর্ম লুট করা, ওদের প্রার্থনা বেশি বেশি টাকা কিংবা খাদ্যসামগ্রী আসা, ওদের বিনোদন অস্ত্র এবং মানুষ মারার মহোৎসবে অংশগ্রহণ–আমি অসহিষ্ণু হবো না তো কে হবে–অসহিষ্ণু হওয়ার এত কিছুর মধ্যে বাস করে কেইবা সহিষ্ণু থাকতে পারে–আমি তো নই-ই–কারণ এই জুনে আমি সাতাশ বছর বয়সে দাঁড়িয়েছি। দময়ন্তীর সঙ্গে ইন্টারনেটে পরিচয়–তারপর চিঠি লেখালেখি, পরিচয় অনেক দিনের হলেও ওর সঙ্গে দময়ন্তীর দেখা তো এই প্রথম, ওকে নিয়ে ও যেন আর ব্ৰিত না হয়। দেখতে পায় দময়ন্তী খাবারের অর্ডার দিয়েছে গোপালকে–গোপাল খাবার আনতে যায়। দময়ন্তী ওর দিকে তাকায়।
অভিমানী মেয়েটি এভাবে জীবনের মূল্য দিল?
অভিমানী নয় সাহসী–সাহসের সঙ্গে মৃত্যুকে বরণ করেছে মেয়েটি।
খুব কষ্টের মৃত্যু–দময়ন্তীর কণ্ঠে আফসোস।
মরেছে ভালো হয়েছে–পোকার মতো বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো–বাবা-মা তো যৌন সুখ মেটাতে গিয়ে সন্তান উৎপাদন করে, সে জন্য বেঁচে থাকার দায় না রাখলেইবা কী!
তন্ময়ের কথায় ব্ৰিত হয় দময়ন্তী।তি কণ্ঠে বলে, আজ আমি তোমাকে একটুও বুঝতে পারছি না–চিঠিতে তুমি জীবনের পক্ষে কথা। লিখতে প্রবলভাবে, আশাবাদী মানুষ হিসেবেই তোমাকে আমি চিনেছিলাম। আজ তুমি এমন ক্রুদ্ধ কেন?
ভাত খাও। তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। কতটা রাস্তা গাড়ি চালালে!
গাড়ি চালালেই ক্ষিদে পায় না।
পায়। তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে।
মুখ শুকিয়েছে তোমার কথা শুনে।
দময়ন্তী গম্ভীর হয়ে বলে–ও তন্ময়ের দিকে তাকায় না–তন্ময় বেশ মজা পায়–বিষয়টি উপভোগ করে–মনে হয় আজ যেন ওর উড়াল দেবার দিন–বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ও এক ভীষণ মুক্ত মানুষ–এখানে ওর চারপাশে কেউ নেই যার জন্য ওর দায় আছে–যার কথা ভেবে কষ্ট পাবে–কিংবা তার জন্য খানিকটুকু করার জন্য এক পা এগোবে।
গোপাল ভাত-তরকারি এনে টেবিলে রাখে। দারুণ অর্ডার দিয়েছে দময়ন্তী–কই মাছ, পাবদা মাছ, মুড়িঘন্ট, পটোল ভাজি, বেগুন ভাজি, টক দই–তন্ময় চোখ বড় করে বলে, করেছ কি?
খাও, খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো।
আমার মাথা একদম ঠান্ডা–এন্টার্কটিকা মহাদেশের মতো বরফে ঠাসা।
কথা শুনে মনে হয় না। রেগে আছ? তা বলতে পারো। ও বাব্বা, এটা আবার মুখে স্বীকার করছ!
দময়ন্তী কথা না বলে ভাত খায়–প্লেটের দিকে ওর গভীর মনোযোগ–সন্তর্পণে কই মাছের কাঁটা বাছছে।
তুমি কই মাছ পছন্দ করো দময়ন্তী?
ভীষণ। তুমি?
পছন্দ করি, তবে কাঁটাটা বিরক্তিকর। কেউ কাঁটা বেছে দিলে খুশি হই।
বেছে দেব?
উঁহু, এটা বাড়ি না। রেস্তোরাঁয় বসে এসব চলে না। নিজেই বেছে খাব। অসুবিধা হবে না। মাছের সাইজটা বেশ বড়, ভালো লাগছে। খেতে।
এমন সময় গোপাল ছোট একটি বাটিতে একটুখানি আচার নিয়ে এসে তন্ময়ের সামনে রেখে বলে, এটা আপনার জন্য।
কেন, আমার জন্য কেন?
আপনি যে আমার দেশের লোক। আপনাকে আমি আর কী দেব! পারলে তো নেমন্তন্ন করতাম, কিন্তু আমার তো বাড়ি নাই। এই আচারটুকু লুকিয়ে আপনার জন্য নিয়ে এসেছি। খান। খেলে আমি খুব খুশি হবো।
আমার বান্ধবীকে না দিয়ে কি খাওয়া যায়? ওকে দিই?
দিন। দুজনে খান।
গোপাল ওদের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তন্ময় জিজ্ঞেস করে, কত দিন হয় দেশ থেকে এসেছিস গোপাল?
তিন বছর।
একা এসেছিস?
না, দুই বোনের সঙ্গে।
বাবা-মা কোথায়?
দেশেই আছে। ভিটে-জমি আছে যে। ছেড়ে আসবে কেন?
তোরা এলি কেন?
গোপাল মুখ নিচু করে চুপ করে থাকে।
তন্ময় নরম স্বরে বলে, তোদের কী হয়েছিল গোপাল?
আমার দুবোনকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে গিয়ে…
হয়েছে, আর বলতে হবে না। বুঝেছি। ছাড়া পাওয়ার পর বাবা-মা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, না?
হ্যাঁ, গোপাল কাঁদকাঁদ কণ্ঠে বলে।
তোদের তাও পালিয়ে আসার জায়গা আছে। আমার নেই। আমি মানে আমার মতো কোটি মানুষ।