কেন?
ওর তো পাসপোর্ট নেই–লুকিয়ে এখানে কাজ করতে এসেছে–তুমি যদি পুলিশকে বলে দাও। তোমাকে বিশ্বাস কি?
তাই তো, আমাকে বিশ্বাস কি–আমি তো ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি কে জানে ও এমন অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছে–মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা না করে বিরুদ্ধাচারণ তো বেশিরভাগ মানুষের স্বভাব–আমি কি এর বাইরে? ও পৃথিবীর দরিদ্রতম ক্ষুদ্র একটি দেশের জনসংখ্যা অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর একজন–এই আঁস্তাকুড়ের মতো ক্ষুদ্র একটি জায়গায় ও তো পায়ের নিচে পিষ্ট মানুষের দলে–ওর কাছে বেঁচে থাকা সত্য–বেঁচে থাকার জন্য ও কাজ খোঁজে–কাজ থেকে টাকা চায়–তা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করতে চায়–কে জানে ওর পরিবার কেমন, ওর বাচ্চারা পরিত্যক্ত শিশু কি না, স্বামী কাজ খুঁজতে গিয়ে ঢাকা শহরে হারিয়ে গেছে কি না–আমি কে যে ও আমাকে সময় দেবে–ওর সময়ের মূল্য আছে–ভোরবেলাতেই ওকে চার-পাঁচটা বাড়িতে কাজ সারতে হয়। ভিন দেশে কাজ করতে এসে সময় নষ্ট করবে কেন ও–আর অবিশ্বাস? অবিশ্বাস তো করবেই–বিশ্বাসের কোনো ক্ষেত্র তো কেউ ওদের জন্য তৈরি করে না–ওরা নিজের গায়ের জোরটুকু সম্বল করে ফাঁকফোকর খুঁজে বেঁচে থাকার রাস্তা বের করে–সেখানে ওর মতো ক্ষুদ্র মানুষের সঙ্গে দেখা করা সময়ের অপচয়–অর্থহীন নিরন্ন হাহাকারের পালে বাতাস লাগা–হায় পৃথিবী, আমাদেরকে আস্তাবলের বাইরে নিয়ে যাও–বুক ভরে বাতাস টানতে দাও।
পেছন থেকে দময়ন্তী এসে ঘাড়ে হাত রাখে।
তুমি নিশ্চয় আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছ?
তন্ময় ওর দিকে তাকিয়ে বলে, তাই তো মনে হয় দময়ন্তী।
তারিখ ভুল লেখার খেসারত দিলে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে। নিশ্চয় খুব খারাপ লেগেছে?
একটুও না। দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ দেখেছি–এই দমদমের কোনো এক বাসার কাজের ঝিকে নিয়ে ভেবেছি। ছবি তোলার কথা ভেবেছি, কিন্তু তোলা হয়নি।
ভারি অদ্ভুত তো! তোমার সময় তাহলে ভালো কেটেছে বলতে পারো।
দারুণ কেটেছে। সময়কে আমি অর্থহীন হতে দেই না।
এই সময়টুকু তোমার কী কাজে লাগবে?
নিঃসন্দেহে কোনো কিছু পরিকল্পনা করার কাজে লাগবে।
দময়ন্তী হো-হো করে হেসে বলে, চলো। তারিখ ভুল করার আরো একটি খেসারত তোমার জন্য আছে।
তুমি আমাকে ঘাবড়ে দিতে পারবে না। বিদেশে যত অ্যাডভেঞ্চার তত মজা। বলো খেসারতটা কী?
এই দুপুরবেলা তোমাকে আমি বাসায় নিয়ে খাওয়াতে পারব না। রেস্টুরেন্টে খেতে হবে।
তথাস্তু। তোমার বাড়ির খাওয়া আমার জন্য তোলা রইল।
শোনো, তুমি তো সন্ধ্যার ফ্লাইটে দিল্লি যাবে। দিল্লি থেকে ফেরার পথে আমার এখানে দুদিন থেকে যেও।
উঁহু, তা হবে না। সময় নেই, আমার দেশে কাজ। অনিমা অপেক্ষা করে আছে।
দময়ন্তী আর তন্ময় ট্রলি ঠেলে ওর গাড়ির কাছে যায়। গাড়ি ও নিজে। চালায়–ড্রাইভার নেই–দুজনে টেনেটুনে স্যুটকেস গাড়িতে তোলে–দময়ন্তী সাদার ওপর কাজ করা চমৎকার একটা শাড়ি পরেছে–গলায় লম্বা মালা–বয়স তো পঞ্চাশের ওপরে–কিন্তু দেখে মনে হয় কম–লম্বায় বেশি না–খানিকটা মটুসটু–ফ্যাটজনিত ত্বকের কারণে মুখে লাবণ্য থির হয়ে আছে। ওর দুই ছেলে আমেরিকায়–কলকাতার ফ্ল্যাটে একা থাকে–বন্ধুবান্ধব অনেক–পুরুষ বন্ধুর সংখ্যা বেশি–বিদেশি স্বামী অনেককাল আগে ওকে ছেড়ে চলে গেছে–সেটা নিয়ে ওর মাতম নেই–বরং বেপরোয়া উন্মাদনায় জীবন উপভোগের তৃষ্ণায় ছটফটানি আছে–সমাজসেবা করে ও তো ভালো আছে–ভালোই থাকবে।
ওরা যে রেস্তোরাঁয় ঢোকে তার নাম নীলাঞ্জনা’।
তন্ময় বলে, নাম দেখেই বুঝতে পারছি প্যানপেনি বাঙালিয়ানার মধ্যে ঢোকালে আমাকে।
ও হালকা কর্তৃত্বের সুরে বলে, বসে পড়ো। আশপাশে আর ভালো রেস্টুরেন্ট নেই। আমারও ক্ষিদে পেয়েছে।
দময়ন্তী দুই চেয়ারঅলা একটি ছোট টেবিল দখল করে। খদ্দের কম নেই–ধুম খাচেছ সব–ভর্তা, ভাজি, ডাল, মাছ এসব পরিবেশ দেখে তন্ময়ের খাওয়া মাথায় ওঠে–দেশের বাইরে ও নিজের দেশের খাবার খেতে চায় না। কী আর করা, চেয়ার টেনে বসে। হঠাৎ করেই ওর লন্ডনের নান্দোস রেস্টুরেন্টের কথা মনে হয়–প্রচুর ঝাল দিয়ে চিকেনের ডিশটা ওর জিভে জল আনে। স্বাদ এমনই যে জিহ্বা পুড়ে গেলেও সেদিকে খেয়ালই থাকে না।
কী খাবে বলো? এই যে মেনু।
তুমি যা খুশি তা অর্ডার দাও। আমার কোনো বাছাবাছি নাই। কারণ খাবারটা আমি খাচ্ছি তোমার পাল্লায় পড়ে–অনুরোধে পেঁকি গেলা আর কি!
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলে, তাহলে কলকাতার একটা জিনিস তোমাকে খাওয়াতে পারি, সেটা তুমি পৃথিবীর যত দেশে গেছ সেসব দেশের
কোথাও খাওনি।
স্বাদ কেমন?
খেয়ে বুঝে দেখো। তাহলে অন্যখানে যেতে হবে।
না বাপু, আমি আর লড়ালড়ি করতে পারব না। জিনিসটা কী বলে? দময়ন্তী তন্ময়ের চোখে চোখ রেখে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, বিষ।
তন্ময় শব্দ করে হেসে ওঠে। আশাপাশের টেবিলের লোকজন ওদের দিকে তাকায়। তন্ময় ক্ৰক্ষেপ করে না। জোরে জোরেই বলে, মাত্র গতকাল ঘটেছে এমন একটি ঘটনার কথা কি আমি তোমাকে বলব?
দময়ন্তীর কণ্ঠস্বর এবার একটু নরম হয়। আস্তে করে বলে, বলো।
গত কয়েক দিন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের ফলে ভেসে গেছে বাংলাদেশের অসংখ্য এলাকা–গরিব মানুষের দুর্দশা সীমাহীন–ঘর ড়ুবে গেছে–ঘুমুনোর জায়গা নেই–কাজ নেই তো চাল কেনার পয়সা নেই–রিলিফের কত তোড়জোড় টেলিভিশনের পর্দায়–গুটিকতক মানুষের কাছে পৌঁছে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য–বাকিরা ঠুটো জগন্নাথ–এক ঘঁটে কুড়ানি মা তিনদিন ধরে ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু জোগাড় করতে পারেনি–চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়েটি মায়ের কাছে ভাত চায়–মা ভাত কোথায় পাবে–ভাত জোগাড় করতে না পারার বেদনার সঙ্গে ওর ক্রোধও আছে বুকের ভেতরে–অক্ষমতার যন্ত্রণা বড় নির্মম–মেয়ে আবার ভাত চাইলে মা বলল, ভাত নাই, বিষ খা।