তন্ময় হাঁটতে থাকে। রাস্তার ধারের ঝুপড়ি চায়ের দোকান খুঁজতে থাকে। তখন রাস্তা সরব হয়ে উঠেছে। গাড়ি-রিকশায় সয়লাব হয়ে উঠেছে রাস্তা। ও আবার দাঁড়ায়। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তাক করে।
তখন সাবিহা বানুর ঘুম ভাঙে। বুকটা খচ্ করে ওঠে। তন্ময় কি ঘরে আছে? ছেলেটা যখন উধাও হয় একটু বলেও যায় না। আগে বলত আর মায়ের কাছ থেকে বাধা পেত। মন খারাপ করে বসে থাকত। কিছুকাল ঘরে থেকে ও না বলে চলে যাওয়ার উপায় বের করেছে–একটা চিঠি এখন মা-ছেলের সেতুবন্ধ।
সাবিহা বানু তন্ময়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ওর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘর খালি। ওর ব্যাগ এবং ক্যামেরা নেই দেখে সাবিহা বুঝে যায় যে, ছেলে উধাও হয়েছে। নিশ্চয় ফুলদানির নিচে চিঠি রেখে গেছে। সাবিহা ঘরে ঢুকে চিঠিটা নেয়। তন্ময় লিখেছে, মা, বরাবরের মতো আবারো বেরিয়ে পড়েছি। একটুও ভেব না। আমি জানি তুমি কখনোই ভাব না যে ছেলেটা বখে গেছে। তুমি ভাব ছেলেটা নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। সোনা মা আমার, প্রজাপতি মা আমার। কিছু ভেব না। অল্পদিনে ফিরে আসব। অনেক আদর আর ভালোবাসা। তোমার আদরের ছেলে বাজপাখি তন্ময়।
সাবিহা বানু বিষণ্ণ হয়ে চিঠিটা একটি ছোট সুন্দর কাঠের বাক্সে রাখে। দেখা যায় অনেক রঙের কাগজে লেখা অনেক চিঠি জমে আছে। কখনো কোনো চিঠি ফেলে দেয়নি সাবিহা বানু। প্রথম দিকে টেবিলের ড্রয়ারে চিঠিগুলো রেখে দিত। তারপর একটি সুন্দর বাক্স কেনে। আজো চিঠিটা দুতিনবার পড়ে বাক্সে ঢুকিয়ে রাখে।
তন্ময়ের ঘরটা নিজেই গোছায়। যেখানেই যায় সেখান থেকে কিছু নাকিছু আনবে। ফলের বীচি, গাছের গোটা, রঙিন পাতা, দোকানের কিছু, একটি রুমাল কিংবা বাঁশের ফুলদানি, মাছ ধরার খলুই, বাবুই পাখির বাসা ইত্যাদি হরেক জিনিস। ঘরজুড়ে ছড়িয়ে থাকে। সাবিনা বানু কোনোটা দেয়ালে টানায়, কোনোটা ঘরের এখানে-সেখানে সাজায়। বাড়ি ফিরে তন্ময় চেঁচিয়ে বলবে, মা, আমার বাবুই পাখি মা। ঠিক বাবুই পাখির বাসার মতো বুনেছ আমার ঘর। সাবিহা বানুর মনে হয় ছেলের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে ও। শুধু ও এখন সামনে নেই।
তখন ফুলমসি স্টেশন মাস্টারের ঘরে তৌফিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। দু-মাস হলো দূরখালি স্টেশন থেকে এখানে বদলি হয়ে এসেছে। জায়গাটা পছন্দ হয়েছে অনিমার। আসার পরপরই স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছে। একজনের লিভ ভ্যাকান্সিতে অবশ্য। তাতে কী, মেয়েটার সময় তো কাটবে। হঠাৎ হঠাৎ ওর চোখে জল দেখলে চমকে ওঠে তৌফিক। ভয় হয়। মেয়ের ভাবনায় হাতের কাজ থেমে যায়। চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দেয়ার সময় শুনতে পায় অনিমার কণ্ঠ। বাইরে কারো সঙ্গে কথা বলছে। একটু পরে ঘরের ভেতর মুখ বাড়ায়।
বাবা কি করছ?
আয় মা। তুই কী করছিলি?
স্কুল থেকে এসে তোমার জন্য দুটো কই মাছের দোপেঁয়াজা করেছি বাবা। চিংড়ি দিয়ে মিষ্টি কুমড়ো ভাজি করেছি। তুমি খেয়ে বলবে আমি মুগের ডালটা খুব ভালো বেঁধেছি।
বাহ্, শুনেই আমার পেট ভরে যাচ্ছে। এই নতুন স্টেশনে এসে তোর কি ভালো লাগছে মা?
হ্যাঁ, বাবা, খুব ভালো লাগছে, ঘর-দুয়ার গোছাতেই যা একটু কষ্ট হয়।
তুই তো দিব্যি কদিনের মধ্যে বেশ গুছিয়ে ফেলেছিস। আমার কাজের মেয়ে, সোনাকুট্টি মেয়ে।
তুমি যে আমাকে কত ভালোবাস বাবা! আকাশের সমান, পাহাড়ের সমান।
হা হা করে হাসে অনিমা। তৌফিকও। দুজনেরই মনে হয় এসব বলার কথা নয়। তবু বলতে ভালো লাগে, বলাটা মজার হয় এবং কখনো ছোটবেলার খেলার মতো। হাসি থামলে তৌফিক বলে, তাই তো মাঝে মাঝে ভাবি, তোর বিয়ে হলে আমার কী হবে!
মেয়ের দিকে তাকিয়ে তৌফিক চোখ মোছে। অনিমা বাবার দিকে তাকিয়ে প্রথমে থমকে যায়, তারপর বলে, বাবা তুমি এমন করলে আমার যেদিক দু-চোখ যায় সেদিকে চলে যাব। স্টেশনে কেউ নেই, আমি এখন বাইরে গিয়ে ঘুরে বেড়াব। তুমি কাজ করো। ফাঁকা স্টেশন অনিমার বেশ লাগে। হুহু বাতাস এ-মাথা থেকে ও-মাথায় বয়ে যায়। গত পনেরো দিন রাজীবের কোনো খুব নেই। ও অবশ্য যাবার সময় বলে গিয়েছিল, আমার চিঠি না পেলে একটুও ভেব না। মনে করো যে আমি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত আছি।
কিন্তু কদিন ধরে অনিমার কিছু ভালো লাগছে না। কোনো কিছুতে মন বসছে না। স্কুলের বাচ্চাগুলোর সঙ্গেও অনেক সময় কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ও স্টেশনের সিমেন্টের বেঞ্চের ওপর পা উঠিয়ে বসে। তখন একটি কাগজ হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসে মাসুম।
আপা–
মনে হয় আপা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওর দম বুঝি ফুরিয়ে যাচ্ছে। লম্বা শ্বাস ফেলে মাসুমের চোখ জলে পূর্ণ হয়ে ওঠে।
কী হয়েছে মাসুম?
এই দেখেন।
ও কাগজটা মেলে ধরে।
একটা দুর্ঘটনার খবর ছাপা হয়েছে।
কাগজটা রেখে ও চলে যায়। অনিমা কাগজ হাতে নিয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় নিহত রাজীবের ছবি ও রাজপথে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। ছবির নিচে লেখা আছে : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্র রাজীব সরকার বাসের ধাক্কায় দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। অনিমা কাগজটা বুকে জড়িয়ে ধরে হাঁটুতে মাথা গোজে। না ঠিক হচ্ছে না। ও এখন চিৎকার করে কাঁদতে চায়। চিৎকার করে বলে, এই তোমার ফিরে আসা—এভাবে–চারদিকে হা-হা শূন্যতার মাঝে অনিমার বোবা কান্না প্রবল শূন্যতায় বাতাস ভারী করে তোলে।
একটু পরে ট্রেন আসবে। দু-চারজন করে লোক প্লাটফর্মে জমায়েত হতে শুরু করেছে। অনিমা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায়। কেউ কেউ ওকে দেখে। তারপর পোটলা-পুঁটলি নিয়ে এক জায়গায় বসে পড়ে। মাসুম তাহেরাকে নিয়ে অনিমার কাছে আসে।