সেই থেকে বাবা আবার ভাত খাওয়া শুরু করেছিল। এখন যদি আবার কোনো ট্রেন দুর্ঘটনায় বাবার মন খারাপ হয় তাহলে কে ওর বাবাকে ভাত খাইয়ে দেবে? মা তো নেই। তাহলে কি ওর বাবা ভাত না খেতে খেতে মরে যাবে! অনিমা নিজের ছেলেমানুষি ভাবনায় বিরক্ত হয়। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে বলে, বাবা আমি তোমার ছবির একটা অ্যালবাম। বানাতে চাই।
আমার তো অত ছবি নেই মা।
তুমি আর আমি শহরে গিয়ে অনেক ছবি তুলব।
তুলব, তোর কথাই ঠিক। আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে মা।
চলো, তোমাকে আগে খেতে দেই।
অনিমা রান্নাঘরে ঢুকলে তৌফিক চেঁচিয়ে মেয়েকে ডাকে। বাবার কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক মনে হয় অনিমার কাছে। ও দ্রুত কাছে এসে বলে, কী হয়েছে বাবা?
আমি ভাত পরে খাব। আগে তোর মায়ের ছবি দেখব।
অনিমা আর কোনো কথা না বলে অ্যালবাম নিয়ে এসে বাবার সামনে রাখে। তৌফিক অনেকক্ষণ ধরে অ্যালবামের পাতা ওল্টায়। অনিমা চুপ করে বাবার পাশে বসে থাকে। কিছুতেই বুঝতে পারে না যে বাবার কী হলো। আজ ওর বাবা বেশ লম্বা সময় ধরে ছবি দেখছে।
বোহেমিয়ান তন্ময় আজো বাড়ি থেকে চুপচাপ পালানোর জন্য তৈরি হয়েছে। ওর যখন ইচ্ছে করে তখন ও হুটহাট যেখানে-সেখানে চলে যায়। যত দিন খুশি তত দিন থাকে। শুধু মাকে চিঠি লিখে নিজের খবরাখবর দেয়। সাবিহা বানু বলে, আমার ছেলের পায়ের নিচে সরষে। তন্ময়ের মনে হয়, মায়ের উপমাটা তো অনেককাল আগের কথা। ও নিজে ওর জন্য নতুন উপমা বানাবে। বেশ জুতসই উপমা, না ঠিক হলো না, আধুনিক উপমা, না তাও হলো না শেষ পর্যন্ত পরে ভাববে মনে করে ও ভাবাভাবি ক্ষান্ত দেয়। ওর প্রিয় জিনিস ক্যামেরা। শখ ছবি তোলা। সেজন্যই ওর হাজারো জায়গা খুঁজে বেড়ানো, যেন দারুণ একটি ছবি তুলতে পারে।
তখন ভোর হয়েছে মাত্র। দিনের প্রথম আলোর শুরু। তন্ময় বিছানা ছেড়ে প্রথমে জানালায় দাঁড়ায়। আলোর আভায় ফুটে ওঠা দিনের সূচনা। দেখে। ফিরে এসে বাথরুমে যায়। টেবিলের ওপর ব্যাগ আর ক্যামেরার ব্যাগ রাখা। রাতেই সব কিছু গুছিয়ে রেখেছিল। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়েই মাকে চিঠি লেখে। ফুলদানির নিচে ভাজ না-করা চিঠিটা রেখে দেয়, যেন মা দূর থেকেই চিঠিটা দেখতে পায়। তাহলেই বুঝে যাবে যে ছেলেটা পালিয়েছে।
নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ও মায়ের ঘরে উঁকি দেয়। সাবিহা বানু ঘুমিয়ে আছে। ও নিজেকে বলে, মা কখনো ভোরে উঠতে পারে না। বেচারা ইনসমনিয়ার রোগী। বাবা মারা যাবার পরে সেটা আরো বেড়েছে। ও মৃদু স্বরে বলে, যাচ্ছি মা, তোমার জন্য চিঠি রেখে গেলাম। তুমি আমার কাছ থেকে শুধু এটুকুই তো চাও।
সিঁড়ি দিয়ে খুব নিঃশব্দে নামে। যেন বাড়ির কাজের মানুষদের ঘুম না ভাঙে। তাহলেই চেঁচামেচি শুরু করবে। মাকে জাগিয়ে ফেলবে। গেটের একটা ড়ুপ্লিকেট চাবি আছে ওর কাছে। ধীরেসুস্থে গেট খুলে বেরিয়ে যায় ও। গেটটা মুখে মুখে লাগিয়ে রাখে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে বলে, পুরো ধরিত্রী আমার।
ফুটপাথে বসে ছোট মেয়ে সখিনা ফুল গোছাচ্ছে বিক্রি করার জন্য। তন্ময় ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সখিনা হাসিমুখে ওর দিকে তাকায়। নিরন্ন, শুকনো চেহারার চোখজোড়া দারুণ তীক্ষ। ওকে দিয়ে একটা কিছু হবে–তন্ময়ের মনে হয়। ও সখিনাকে বলে, তোমার একটি ছবি তুলি?
সখিনা চটপট উঠে দাঁড়ায়। একগুচ্ছ ফুল বুকের কাছে ধরে পোজ দিয়ে বলে, সুন্দর কইরা তুলবেন কিন্তু। আমারে একড়া ছবি দিবেন। আমার মারে দেখামু। মা খুশি হইয়া কইব, ও আল্লারে, আমার সখিনা কত সোন্দর! আল্লা অরে য্যান বাঁচাইয়া রাখে।
তন্ময় ছবি তোলে। কয়েকটা ছবি তুলে সখিনার মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। এ বয়সে ও ফুল বেচবে কেন? ওর কি আরো কিছু পাওনা ছিল না? সখিনা বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে, তাকায়ে আছ ক্যান? ছবি ভালো হয় নাই?
তন্ময় জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে, না একটুও ভালো হয়নি। এটা কোনো ছবিই। এমন ছবি তুলতে আমার লজ্জা হয়।
সখিনার ভীষণ মন খারাপ হয়। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, আমারে খুব খারাপ দেহাইতাছে?
তন্ময় ওর বিপ্ন দৃষ্টি উপেক্ষা করে অবলীলায় বলে, হ্যাঁ, ভীষণ খারাপ দেখাচেছ।
আমারে দেহাও না। কেমুন খারাপ লাগতাছে আমি দেহি।
তন্ময় ওর ডিজিটাল ক্যামেরায় সখিনাকে ছবি দেখায়। সখিনা ছবি দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলে, আল্লারে কী সোন্দর দেহাইতাছে!
তুমি খুশি হয়েছ সখিনা?
সখিনা ঘাড় কাত করে লম্বা করে টেনে বলে, হ–খুব খুশি হইছি। আমার মাও খুশি হইব। কইব, ও আল্লারে আমার সখিনা তো একডা ফুটফুইটা মাইয়া!
তন্ময় হো-হো করে হাসে। সখিনার স্মার্টনেস দেখে খুব মজা পায়। তারপরও বলে, কিন্তু এটা তোমার ছবি নয়। তোমার ছবি এমন হওয়া উচিত। তন্ময় ওকে অন্য একটা ছবি দেখায়। সখিনা ছবি দেখে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। স্কুল ইউনিফর্ম পরে বই-খাতা হাতে নিয়ে ও দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে ও উৎফুল্ল হয়, তারপর আবার বিষণ্ণ হয়ে যায়। বলে, ধুত এইডা আমার ছবি না। আমি তো কোনো দিনই স্কুলে যাই নাই। আপনে মিছা ছবি তোলেন ক্যান?
সখিনা ফুলের গোছা উঠিয়ে নিয়ে গোছগাছ করতে করতে তন্ময়ের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তন্ময় অবাক হয় না। ও তো আগেই বুঝে নিয়েছিল যে সখিনা মেধাবী, ওর চোখ সে কথা বলে দেয়। ও চিন্তা করতে পারে। ও তো মুহূর্তে বুঝতেই পারবে যে ওর অবস্থান কোথায়। ও দেখতে পায় ও ফুল নিয়ে রাস্তায় সিগনাল বাতির নিচে গিয়ে। দাঁড়িয়েছে। এখন শুরু হবে ওর ছোটাছুটি। এ সত্য ওর চেয়ে বেশি কে কঠিনভাবে জানে! ও নিজেকেই বলে, তুমি বললে এটা মিথ্যে ছবি। এটাই তো সত্য হওয়া উচিত সখিনা। এই সত্য ছবির ধারণা থেকে তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তোমাকে এই জীবনের ধারণাও পেতে হবে।