শিরিন কোনো উত্তর দেয়নি তার এতগুলো প্রশ্নের। তখন রুবি নিজেই গা মটমট করে মুচড়ে, হাই তুলে বলল, তুই ও বাপু, আজকাল কেমন হয়ে যাচ্ছিস। রকে বলি রাতে আরো একটু বেশি আদর করতে। তাহলে সারাদিন মেজাজ ভালো থাকবে। আজকাল আর আদর করে না বুঝি? পুরনো হয়ে গেছিস? নতুন খুঁজছে। নাকি?
বুকের ভেতরে ধ্বক করে উঠল শিরিনের। কিন্তু একি অলক্ষুণে সন্দেহ পেয়ে বসেছে শিরিনকে? সে রাতের পর থেকে সর্বক্ষণ চোখ মেলে আছে সে, একটা দিনও তো এমন কিছু চোখে পড়েনি, যাতে সন্দেহটা সত্য হয়ে যেতে পারে। তাহলে?
বুকের ভেতরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে শিরিনের। একদিন সামাদকে সে বলেই ফেলে, রুবিকে আপনি চলে যেতে বলেন।
না।
এক মুহূর্তের জন্যে কি তখন মরে গিয়েছিল শিরিন? সামাদ স্পষ্ট গলায় বলতে পারল–না?
না, সে যাবে না। আমি তাকে যেতে দেব না।
শিরিন প্রাণপণে চেষ্টা করল কেন? এই কথাটা একটিবার উচ্চারণ করতে, কিন্তু কিছুতেই পারল না। সমস্ত দেহ যেন তার হাতছাড়া হয়ে গেছে।
উত্তরটা নিজেই দিল সামাদ। পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, তুমিই তো বলেছিলে, তোমার বোন সুন্দরী, তার গায়ে হাত দিতে আমার ইচ্ছে করে কিনা, তুমিই তো জানতে চেয়েছিলে? চাওনি? তাহলে থাকুক, সারা জীবন থাকুক তোমার বোন-আর তুমি দ্যাখো, চোখ ভরে দ্যাখো। তুমি দেখতে না চাইলেও, দেখবে। দেখতে তোমাকে হবে।
সামাদের পায়ের ওপর মাথা খুঁড়তে পারত শিরিন; কিন্তু সে শক্তিটুকু তার আর অবশিষ্ট নেই।
সামাদ সব পারে, এতদিনে এটা বুঝে গেছে শিরিন। এমনকি কাল থেকে রুবির সঙ্গে শুতে গেলেও অবাক হবে না সে। কিন্তু রুবি কি করবে? সেও কি শিরিনের চোখের সমুখে, শিরিনের সংসারের বয়েসেই সামাদকে নিয়ে দুয়োরে খিল দেবে? দিতে পারবে?
হয় তো পারবে। রুবিকেও অচেনা মনে হয় শিরিনের। যে রুবির সঙ্গে কৈশোর থেকে সে বড় হয়েছে, সে রুবি এ নয় বারবার এটাই শুধু মনে হয় শিরিনের।
আর দাউ দাউ করে বুকের ভেতরে আগুন জ্বলে।
দিন সাতেক পরে শিরিন হঠাৎ লক্ষ করে রুবি আর সেই আগের রুবির মতো হাসে না, যখন তখন উচ্ছল গলায় রসিকতা করে ওঠে না, সামাদের হাত ধরে টানাটানি করে না।
শিরিন লক্ষ করে, সামাদ সেই আগের মতই মাথা নিচু করে খায়, চোখ বুজে রেডিও শোনে, সেই আগের মতই ঘুমোতে যাবার আগে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে একবার অধিকার করে নেয় শিরিনকে।
যেন এ বাড়িতে রুবি নেই। রুবি কখনো আসেনি। যেন আগের সব আবার চলছে।
দুপুরে একদিন রুবি তার হাত ধরে বলে, শিরিন, এবার যেতে হয়, কবে যাবো বল?
তখন অকস্মাৎ এক পরম ঔদার্য পেয়ে বসে শিরিনকে। রুবির চিবুক ধরে সে বলে, কটা দিন যাক না। আর কি আসা হবে?
কেন, ওকথা বলছিস কেন? আবার ডাকলেই আসব। নাকি আর ডাকবি না কোনোদিন? বল কেন বলছিস?
কিছু না। এমনিই নিশ্চয়ই কিছু। বল তুই আমাকে।
না। কিছু না। কিছু না।
জোর করে হাত ছাড়িয়ে উঠে যায় শিরিন। পেছনে পেছন এসে দাঁড়ায় রুবি।
শিরিনের কাঁধে হাত রেখে রুবি বলে, হটাৎ সেই উদ্দাম খিল খিল হেসে উঠে, ভেবেছিস তোর র আমি চুরি করে নিয়েছি, বোকা, তুই একটা বোকা। আর কিছু না তুই মস্তবড় বোকা।
দপ করে আবার সেই আগুন জ্বলে উঠল শিরিনের বুকের ভেতর। মূচ্ছিত হয়ে পড়ে গেল সে।
সেদিন সকাল থেকেই মেঘ করেছিল। বিকেল নাগাদ সারা আকাশ ছেয়ে গেল ঘন কালো মেঘে। সন্ধ্যের আগেই নামল অকাল সন্ধ্যে। তারপর মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজেই ফিরে এলো সামাদ তার কলেজ থেকে। এসে দেখল বিছানায় ঝরে পড়া একটা বিবর্ণ পাতার মতো শুয়ে আছে শিরিন। চোখ তার বোঁজা।
ঘরে পা দিয়ে শিরিনকে দেখেই রুবির দিকে তাকিয়েছিল সামাদ। রুবি এসে খাটের বাজু ধরে বলল, শিরিনের অসুখ, আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন, আমি চা দিচ্ছি।
শিরিন চোখ খুলতে চেয়েছিল, শক্তি হয়নি চোখ খুলবার। বলতে চেয়েছিল, আমার কোনো অসুখ হয়নি, শক্তি পায়নি উচ্চারণ করবার। যেন সে প্রবল একটা নেশা করেছে, সব বুঝতে পারছে কিন্তু সাড়া দিতে পারছে না।
অনেক রাতে তার মনে হলো সামাদ এসে পাশে শুয়েছে। তখন অনেক কষ্টে চোখ খুলল শিরিন। তাকিয়ে দেখল, লণ্ঠনের আলোয় ঘরের ভেতরে অকিায় ব ছায়া পড়েছে, বাইরে তুমুল শব্দ তুলে অব্রিাম বৃষ্টি পড়ছে, কোথাও একটা ভোলা জানালা অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়ছে। তখন আবার চোখ বুজলো শিরিন। বুকের আগুন সারা দেহে ছড়িয়ে পড়েছে তার। দেহটা সত্যি এবার জ্বলছে। মাংসের প্রতিটি কোষ একে একে পুড়ে যাচ্ছে। কত কোটি কোষ আছে মানুষের দেহে? পুড়ে ছাই হতে কত অযুত বছর লাগে?
কপালে হারে স্পর্শ টের পায় শিরিন। সামাদের হাত। সমস্ত জ্বর যেন নিমেষে থেমে যায়। বাইরে বৃষ্টির মতই শীতল হয়ে আসে সারা শরীর।
সামাদ যদি এখন তাকে একবার বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরত-এর তাকে দুহাত দিয়ে ঘিরে ধরত।
হঠাৎ কপাল থেকে হাতটা সরে যায়। শিরিন চোখ মেলে অতিকষ্টে। দ্যাখে, বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে সামাদ। তখন শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে শিরিন আঁকড়ে ধরে সামাদের হাত।
যেন বহুদুর থেকে সামাদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
পাশের ঘরে পানি পড়ে বেশি বৃষ্টি হলে একবার দেখে আসি।
হাতটা প্রাণপণে চেপে ধরে শিরিন। সমস্ত শক্তি জড়ো করে উচ্চারণ করে, না।