স্বামীর জন্যে বারণহীন হয়ে ওঠে শিরিনের মমতা। এইতো সেই মানুষ যাকে সে বিয়ের পর প্রতিটি দিন প্রার্থনা করেছে, কিন্তু যার দেখা কোনদিনই সে পায়নি।
সামাদের সমস্ত ব্যবহার, তার সমস্ত রূঢ়তা এখন যেন অন্যজনের বলে মনে হতে লাগল শিরিনের। স্বামীর কাছে সোহাগ করাও সম্ভব বলে মনে হলো তার।
শিরিন বলল, রুবির কপালটা দেখেছেন? এমন সুন্দরীকে ছেড়ে বর চলে গেল।
কেন গেল?
কে বলবে? পুরুষেরা ব পারে?
পারে বুঝি?
সামাদ একটু হাসলো মনে হলো। তখন আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো শিরিন।
পুরুষেরা সব পারে। বিশ্বাস কি?
তারপরই অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসল শিরিন।
রুবি খুব সুন্দরী, না?
হুঁ।
আমার চেয়েও?
পাশ ফিরল সামাদ শিরিনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে।
বললেন না? আমার চেয়েও সুন্দরী?
সামাদ কোনো জবাব দিল না।
রুবিকে নিয়ে খারাপ কিছু মনে হয় না আপনার?
রুবিকে নিয়ে?
সামাদ এবার উপুড় হয়ে বালিশের ভেতরে মুখ গুঁজে দিল। আধো উঠে বসে শিরিন তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে জানতে চাইল, মনে হয় না আপনার?
না।
সত্যি না? কেন? ওতো অনেক সুন্দরী? কি সুন্দর ওর মুখ, ওর চুল, ওর শরীর, কি সুন্দর হাসে, কথা বলে।
সামাদ নিঃশব্দে মুখ ঘষে বালিশে।
শিরিন এবার উঠে বসে বিছানায়।
আচ্ছা রুবি যখন আপনার হাত ধরে টানে, আপনার ভালো লাগে না? গায়ের ভেতরে কেমন করে না? মনে হয় না, আমি না থাকলে ওর সঙ্গে থাকতে পারতেন? মনে হয় না? ওর গায়ে হাত দিতে ইচ্ছে করে না? করে না? করে না?
ঠাস করে চড় এসে পড়ে শিরিনের গালে। হিস হিস করে সামাদ উচ্চারণ করে, বাজারে বেশ্যা হলেই পারতে।
পাশের ঘরে রুবি তখনো জেগেই আছে, সেটা দুজনেই বুঝতে পারে যখন হঠাৎ নড়াচড়ার শব্দ শোনা যায়। জোর করে উদ্গত কান্না চেপে রাখতে চায় শিরিন। কিন্তু কণ্ঠ নামিয়ে রাখার কোনো দায়িত্ব বোধ করে না সামাদ। গলা তুলে সে বলে, সন্দেহ করলে সন্দেহই সত্যি করে দেব তখন বুঝবে।
একি করল শিরিন? নিজেই যে কথার সুত্রপাত করেছিল তা যদি এমন খাদেই গড়িয়ে যায়, তাহলে সে দোষ দেবে কাকে?
নিজেকে?
কিন্তু সামাদ ও কথা বলল কেন? সন্দেহ সত্যি করে দেবার ধমক দিল কেন? তাহলে কি সন্ধ্যেবেলায় যে কথা মনে হয়েছিল, তা তার মুহূর্তের নষ্ট কল্পনা নয়। তার অবচে মনই কি তখন সাবধান করে দিয়েছিল তাকে?
পরদিন, সারা সকাল শিরিন রুবির মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাহর করবার চেষ্টা করল গত রাতের কথাগুলো সে শুনতে পেয়েছিল কিনা।
কিছুই বোঝা গেল না।
রুবি সেই অন্যান্য দিনের মতই দিন শুরু করল সামাদের উদ্দেশে তীর ছুঁড়ে। নাস্তা করতে বসেছিল সামাদ। কোথা থেকে তার সমুখে হাজির হয়ে রুবি জানিয়ে গেল যে, সামাদের উচিত মুখখানা আরো গম্ভীর করে তোলা। আজ একটু হালকা দেখাচ্ছে।
কলেজের ছাত্ররা নইলে মানবে কেন?
এ কথা শুনে সামাদ যে একটুখানি হেসেছিল সেটাই খচ খচ করতে লাগল শিরিনের বুকে।
হাসল কেন সামাদ? কই, শিরিনের কোনো কথায় তো এমন করে কখনো সে হাসেনি?
সামাদ বেরুবার সময় শিরিন ছিল কুয়ো তলায়। সেখানে থেকে সদর দরজা দেখা যায় না। হঠাৎ রুবির খিল খিল হাসি উড়ে এলো, যে এক ঝাক পায়রা ছেড়ে দিয়েছে সে হঠাৎ। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল শিরিনের।
তাহলে, আগে থেকেই কি দুজনের ভেতরে একটা কিছু চলছিল, সিরিন যা বুঝতে পারেনি?
বিকেলে রুবি পাটরাণীর মতো বসলো বারান্দায় আয়না কঁকই তেল নিয়ে। রোজই সে এই সময়ে চুল বাঁধে, নিজেকে গুছিয়ে তোলে দুপুরে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে। আজ যখন টান টান করে চুল পেছনে টেনে দুহাত দিয়ে খোঁপা রচনায় ব্যস্ত রুবি, তখন হাতের ঐ তুলে ধরায়, তার ভরা দুটো বুক ঠেলে জেগে ওঠায় অবসন্ন হয়ে গেল শিরিন।
মনে হলো, সামাদকে ভোলাতেই সাজ করছে রুবি। আবার দ্যাখো, কপালে একটা টিপ দিচ্ছে। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আয়নায় দেখছে বারবার।
তারপর রাতেও সেই কৌতুক, সেই হাসি, সেই চাহনি, ঘূর্ণির মতো সেই চলাচল শুরু হলো রুবির। সন্ধে বেলায় খালপাড় থেকে হাত ধরে টেনে আনল সে সামাদকে। চায়ের সঙ্গে বিস্কুটের বদলে দিল এক মুঠো জুই ফুল রেকাবিতে করে ঢাকনা ঢেকে। সামাদ যখন অবাক হয়ে গেল, সে কি নাচন রুবির। শুধু নিজের নয়, সিরিনকেও টেনে নিয়ে এলো সে রান্নাঘর থেকে।
দ্যাখ, দ্যাখ, তোর বরকে দ্যাখ।
এ কি ধরনের রসিকতা?
কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না শিরিন। সে-ই তো ডেকে এনেছে রুবিকে। সেই তো চেয়েছে রুবি এসে দাঁড়াক একবার সামাদের সামনে। তখন দেখা যাবে, শিরিনকে যে প্রশ্নগুলো করে, সে প্রশ্নগুলো তাকেই করা যায় কি না।
এখন কি সে আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে? তার স্বামী? তার সংসার? তার অবলম্বন? তার অস্তিত্ব।
নিজেকে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করল শিরিনের যখন সে রুবিকে দেশে ফিরে যেতে বলল আর তার উত্তরে রুবি বলল যেই তো সবে এলাম। এখনি যাবো কিরে?
তবে কি, শিরিনকে নিঃস্ব করেই চলে যাবার পণ করেছে সে?
সামাদও আর বলে না যে, ওকে এবার যেতে বললো। সেও কি গোপন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে রুবির সঙ্গে। নাকি, নতুন কোনো পরীক্ষা করে দেখছে শিরিনকে?
রুবি একদিন শিরিনকে বলল, হারে, তুই যে চিঠিতে লিখেছিলি, তুই আমাকে আসতে বলেছিস, সামাদের কাছে তা গোপন রাখতে। ব্যাপার কি? আর কি গোপন রাখিস বরের কাছ থেকে? ধর, তোর বরও যদি কোনো কিছু গোন করে তোর কাছ থেকে, তখন কি করবি? নাকি দুজনই কাটাকুটি হয়ে যাক, সেই ভালো? কিরে, কিছু বলছিস না যে।