তার মানে শিরিনকে রান্নাঘরে যা বলেছিল সামাদ, তার সবটুকুই আড়াল থেকে শুনেছে সে।
চলে যেতেই যদি বলছেন, তো আমাকে নিয়ে এত ভয় কিসের সাহেব?
আবার সেই উন্মত্ত খিলখিল হাসি। সে হাসিতে ফুলগাছের ডাল নয়, শরীরের ভেতরে শিরা উপশিরায় এবার কাঁপন লাগে।
তখন জোর করে কঠিন হবার চেষ্টা করে সামাদ। তার শরীরের কোথায় কি একটা তার অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘটে যাচ্ছে সেটা বাইরে থেকে কেউ না বুঝুক, মর্মে মর্মে সে নিজে টের পায়। তখন একই সঙ্গে কণ্ঠস্বর কঠিন এবং মুখ বিকৃত করে বলে, আমি তোমাকে এখানে আসতে বলিনি।
তাই আপনি আমাকে যেতেও বলতে পারেন না, বলেই ঘূর্ণির মতো পাক দিয়ে, বিনা দরকারে বুকের কাপড় টানতে টানতে, হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে চলে যায় রুবি।
একবার স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই এক পলকের জন্যে সন্দেহ হয় যে, রুবির হয়ত মাথার দোষ আছে। নইলে এমন করে কেউ হাসতে পারে?
রুবিকে যে শিরিন স্বামীর কাছে না জিগ্যেস করেই আসতে বলেছে, চিঠিতে তাকে বলেছিল—খবরদার তুই ওকে বলবি না, আমি আসতে লিখেছি, বলবি তুই নিজেই এসেছিল— সেই মিথ্যেটা কি সামাদ ধরতে পেরেছে?
স্বামীর দিকে তাকিয়ে, নিজের আশংকার চেয়ে বড়ো হয়ে ওঠে স্বামীর জন্যে ক্ষীণ একটা সহানুভূতি। শিরিন যেন হঠাৎ বুকের ভেতরে কি করে টের পেয়ে যায়, সামাদ যে প্রবল হাতে এই সংসার ইচ্ছে মতো ঘোরাতে ফেরাতো, এখন সেই হারে ওপর আরেকটি হাত এসে পড়েছে। সে হাত রুবির। সামাদের পক্ষে কিছুতেই যেন আর সে হাতের চাপ না মেনে উপায় নেই।
মমতার ক্ষীণ একটা ধারা অপ্রতিভভাবে বইতে থাকে শিরিনের ভেতরে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে কঠিন করে তোলে শিরিন।
এই তো সে চেয়েছিল। রুবিকে দিয়ে এভাবেই জব্দ করতে চেয়েছিল সামাদকে। নিজের হাতে যা পারেনি, অন্যের হাতে সেই শাস্তিই তো দিতে চেয়েছিল তার স্বামীকে।
মুখ ফিরিয়ে শিরিন চলে যায় স্বামীর সমুখ থেকে। সামাদ আবার ঝুঁকে পড়ে রেডিওর ওপর। আবার সে অস্থির আঙুলে কাটা ঘোরাতে তাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের সেই নিবিষ্টতা তার ভেতরে আর লক্ষ্য করা যায় না।
শিরিন রান্নাঘরে গিয়ে দ্যাখে রান্নার যেটুকু বাকি ছিল রুবি তা নিজেই সেরে নিচ্ছে।
উনোনের লাল আগুনের আভায় রুবিকে ভারী রূপসী দেখাচ্ছে যেন সে এই পৃথিবীর নয়, স্বর্গের, স্বর্গ থেকে নির্বাসিতা।
শিরিনের মনের ভেতরে সমস্ত অনুভূতি পলকে স্থান করে দিল নতুন এক অনুভূতিকে। সে অনুভূতি করুণার সে করুণা তাকে ফেলে অন্য মেয়ের কাছে রুবির স্বামীর চলে যাবার জন্যে।
হঠাৎ মর্মের ভেতরে শিউরে উঠল শিরিন। ঈর্ষা তাকে ছোবল দিয়েছে। একেবারে হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে। যেন ঘর থেকে পা বাড়াতেই গোখরো সাপের মাথায় পা পড়েছে তার।
রুবি যে সামাদকে নিয়ে পরিহাস করে, তাতে নাস্তানাবুদ করে খিল খিল হাসিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেকি শুধু নির্দোষ মজা করবার জন্যে? না, অন্য কিছু? সে কি আমোদ করবার জন্যে পরিহাস? না, আকর্ষণ করবার জন্যে ও জাল ছোড়া?
বুকের মধ্যে টান পড়ে শিরিনের। অন্তঃস্থলের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে। মাথার ভেতরে ঝিঝি পোকা ডাকে।
দূরে সেই শেয়ালটা একবার ডেকে উঠেই হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। কোথায় যেন মরমর করে ওঠে গাছের ডাল।
না, অতটা নিচ নিশ্চয়ই রুবি নয়। তার স্বামী একদিন তাকে ছেড়ে গেছে। সে তো জানেই স্বামী হারাবার শোক কত ভীষণ। জানে না? বিয়ের পর লঞ্চে তুলে দেবার সময় ঘাটে দাঁড়িয়ে শিরিনকে সে কি বলেনি, দেখিস, পালিয়ে যায় না যেন। পাখির মতো পোষ মানিয়ে রাখবি। শেকল দিয়ে রাখবি।
সেই রুবি নিশ্চয়ই শিরিনের বুকে ছোবল দেবে না।
এসব কি ভাবছে সে অবেলায়? ভর সন্ধ্যায়?
কিরে? মুখের দিকে তখন থেকে তাকিয়ে আছিস কেন?
রুবির কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙ্গে শিরিনের। স্বলিত একটা হাসি টেনে কোনোমতে বলে, কিছু না।
পর মুহূর্তে রুবিকে একবার বাজিয়ে দেখবার লোভ সামলাতে পারে না শিরিন। সে বলে ওঠে, তোকে হঠাৎ ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল।
না, কই কেঁপে উঠলো না তো রুবি। কেমন সহজ গলায় বলল, আমি তো সুন্দরই। সবাই বলে। তাই বলে আমার মুখ দেখলে তো আর কারো পেট ভরে না। যা বরকে খেতে দে। জায়গা করে দে। নিজের হাতে মুখে তুলে দেগে, যা।
বলেই আবার সেই অকস্মাৎ বারণহীন নিৰ্বরের মতো হেসে ওঠে রুবি।
যা, দাঁড়িয়ে থাকিস নালো। যা।
রাতে বিছানায় এসে দেখে সামাদ আগে থেকেই শুয়ে আছে, অন্ধকারে। আজ সে নিত্যদিনের মতো রেডিও নিয়ে বসেনি। সোজা শুতে এসেছে দেখে, অবাক হয় শিরিন। একটু খুশি, একটু ভয়, তার মনের ভেতরে ঝড়ের দোলায় দুটি পাতা আছাড় খেতে থাকে।
পাশের ঘরেই রুবি। তাই সে না শুনতে পায় এমন নিচু গলায় শিরিন বলে, রুরি ওপর রাগ করেছেন?
প্রথমে উত্তর দেয় না সামাদ। প্রশ্নটা আবার করে শিরিন। সেই সঙ্গে যোগ করে, ওকে চলে যেতে বলি?
বলবে?
আপনি যদি বলেন।
আচ্ছা, পরে ভেবে দেখব।
সামাদের কণ্ঠস্বরে এতটুকু উত্তাপ নেই, উচ্চতা নেই। এমন স্বর বিয়ের পর এই প্রথম শুনল শিরিন। এই স্বাভাবিকতার জন্যে কতদিন কতরাত মাথা খুঁড়েছে সে।
আরো কাছে ঘেঁষে এলো শিরিন। আলতো করে একটা হাত রাখলো স্বামীর বুকের ওপর।
শুনছেন?
বলো, ঘুমোইনি।