তারপর কঠিন সেই মেঝের ওপর শিরিনকে ঠাস করে ফেলে দিয়ে, প্রাচীন অশ্বারোহীর মতো সামাদ তাকে অধিকার করে নিল তীব্র একটা যন্ত্রণার জন্ম দিয়ে।
ঠিক তখনই সিদ্ধান্তটা নেয় শিরিন। চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত। কাল সকালে উঠেই রুবিকে সে চিঠি লিখবে।
রুবির কথা মনে হতেই শিরিনের কাছে সহনীয় মনে হয় এই রাক্ষসের মতো সহবাস। এমনকি সে প্রত্যুত্তরও দিতে থাকে স্বামীর এই ভালোবাসার। কঠিন মেঝেতে নিজের শরীর ক্ষতবিক্ষত করেও সে রাতে শিরিন তার স্বামীকে পৌঁছে দেয় পর্বতের শিখরে।
.
প্রথমে ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল সামাদ।
এখানে কোথায় থাকবে? ঘর কোথায়? শোবে কোথায়?
শিরিন নিঃশব্দে পড়ার ঘরে বিছানা করে দিয়েছিল রুবির জন্যে। রুবি তার খালাতো বোন। প্রায় সমবয়সী। মানুষ হয়েছে শিরিনদের বাড়িতেই। বিয়ে হয়েছিল দুবছর আগে। তারপর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। সে ফিরে আসে আবার শিরিনের বাবা-মায়ের কাছে। রুবির বাবাও একদিন রুবির মাকে অমনি করে ফেলে গিয়েছিলেন। মেয়েকে সঙ্গে করে বোনের বাড়িতে উঠে এসেছিলেন তার মা।
সারা শরীরে বেসামাল ঢেউ তুলে অবিরাম খসে পড়া শাড়ি টানতে টানতে ধল খল করে হাসতে হাসতে রুবি মুহূর্তেই ভরে দেয় সামাদের সংসার।
শিরিনকে সামাদ বলে, তোমার এই বোনটির একটা বাচ্চা থাকা উচিত ছিল। তাহলে লাগাম পরতো।
সত্যি, লাগাম নেই রুবির।
যখন তখন ঘরের মধ্যে ঢোকে, যখন তখন হাত ধরে টানে, যখন তখন ঠাট্টা করে। তার সে ঠাট্টায় গাম্ভীর্য বজায় রাখা এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সামাদের জন্যে।
আজকাল সামাদ তাই যতটা পারে বাইরে থাকে। সন্ধ্যের পরে, খালপাড়ে গিয়ে বসে থাকে।
হয়ত বসে আছে, হঠাৎ জামার কলারে টান অনুভব করে সামাদ। পেছন ফিরে দেখে রুবি।
এখানে বসে কি হচ্ছে? বাড়িতে বৌ একা নেই বুঝি? তুমি তো আছে? আমি ওর বর নাকি?
বলেই হেসে প্রায় গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ে রুবি। সামাদ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। খালপাড়ে তার ছাত্ররা প্রায়ই আসে আড্ডা দিতে। তারা কেউ ধারেকাছে নেই তো?
চলুন, শিগগির চলুন বাসায়।
হাত ধরে একটানে সামাদকে দাঁড় করিয়ে দেয় রুবি। পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পড়বার পরও হাত ছাড়ে না। এক হ্যাচকা টান দিয়ে রুবি পথ চলতে শুরু করে। ছড়ার মতো সুর করে বলতে থাকে, এই হেট হেট, সামনে ঘোড়া, তফাত যাও।
হাত ছাড়, রুবি।
ছাড়ছি বাবা ছাড়ছি। তবু তো হাতটাই নিয়েছি। অন্য কিছু নিলে বুঝি গলা টিপেই মারনে।
একি কথা বলার ঢং? গম্ভীর মুখে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে সামাদ। হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে রুবি বলে, কি দুলাভাই, কথাটা বুঝি মনে ধরলো? প্ল্যান করছে?
সামাদ তাকে পেছনে ফেলে লম্বা লম্বা পায়ে বাড়ি ফিরে আসে একবারও পেছনে তাকায় না।
ঘরে পা দিয়েই সামাদ শিরিনকে বলে, তোমার বোন দেখছি মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসেছে।
থাক না কিছুদিন। একমাস হলো তো এসেছে।
রান্না করতে করতে জবাব দেয় শিরিন। ভেতরের হাসিটাকে জোর করে চেপে রাখে। স্বামীর বুকে অস্বস্তির কাটা খচ খচ করছে টের পেয়ে এক ধরনের তৃপ্তি হয় তার। সে বলে, বিজয়িনীর মতো গলায়, আপনার অসুবিধা হলে না হয় ওকে বলে দেব চলে যাবার জন্যে।
তাই দিও। কালকেও যেন সে চলে যায়।
সামাদ গিয়ে রেডিওর কাঁটা ঘোরাতে থাকে অস্থির আঙুলে। অনেকক্ষণ। কি জানি কেন, কোন স্টেশনই তার মনে ধরে না। বক্তৃতা ফেলে গান ধরে, গান ফেলে আবার বক্তৃতা, তারপর দুর্বোধ্য ভাষায় কোনো বেতার প্রচার শোনে কিছুক্ষণ, আবার ফিরে যায় গানে।
শিরিন ঘরে এসে জিগ্যেস করে, রুবি কই?
আমি কি জানি? আমি কি করে জানব?
সামাদ তেতো গলায় উত্তর দেয় প্রায় চিৎকার করে। আজকাল শিরিন উপভোগ করতে শিখেছে সামাদের দুর্ব্যবহারগুলো। শিরিন তাই আহত হয় না। স্বাভাবিক কণ্ঠেই শিরিনি জানায়, বাহ, আপনাকেই তো খুঁজতে গেল তখন।
রেডিওর নবে হাত থেমে যায় সামাদের। এক পলকের জন্যে। তারপর সজোরে কাটা ঘুরিয়ে চীনা ভাষার এক বেতার প্রচারে পৌঁছে, বক্তৃতার সেই উচ্চগ্রামের ভেতরে প্রায় লুপ্ত কণ্ঠে সামাদ জিগ্যেস করে, এখনো ফেরেনি?
কই, না। খুঁজে দ্যাখো।
আমাকে তো আপনি বাড়ি থেকে বেরুতে দেন না।
যাও খুঁজে দ্যাখো।
রাতে আমি বেরুতে পারব না।
শিরিন চৌকাঠের ওপর দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে।
খট করে রেডিও বন্ধ করে দেয় সামাদ। শিরিনের একবার মনে হয় এখনি তাকে আঘাত করবে সামাদ। সেই আঘাতের অপেক্ষায় চিবুক সুমুখে ঠেলে দিয়ে উদ্যত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে শিরিন।
সামাদ কিন্তু আঘাত করে না। কথা যখন বলে উঁচু গলাতেও বলে না। প্রায় কোমল, প্রায় চিন্তিত ইতস্তত গলায় সামাদ বলে, গেল কোথায়? ডোবাবে। মান সম্মান সব ডোবাবে।
সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে উপচে পড়া জলধারার মতো খিল খিল একটা হাসি শোনা যায়। চমকে পেছন ফিরে সামাদ দেখে জানালার বাইরে জুইফুলের ডাল সরিয়ে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুবি। তার সেই সকৌতুক হাসির কাঁপন লেগেছে হাতের মুঠিতে ধরা গাছের ডালে। থির থির করে কাঁপছে পাতাপত্র আর শাদা শাদা ফুলগুলো।
তারপর সড়াৎ করে ডাল ছেড়ে দিল রুবি। মুহূর্তে পাতাপত্তরে আবার ঢেকে গেল জানালা। বুঝি এক ঝলক সুবাস সঙ্গে করেই ঘরে এসে দাঁড়াল রুবি। তর্জনী তুলে বলল, তবে যে আমাকে চলে যেতে বলেছিলেন বড়?