আরো অবাক হয়ে যায় শিরিন তার নিজের মনের দিকেই তাকিয়ে। সামাদ তাকে যত আঘাতই দিক, প্রতি রাতে যে তাকে সে গ্রহণ করত, অধিকার করত, সে এতটা পর্যন্ত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, যে, এখন তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লোকটার একপাশে শুয়ে থাকতে সে নিজেকে ভয়াবহ রকমে নিঃস্ব বোধ করছে।
সাহস করে অনেকক্ষণ পরে কাছে সরে এসেছিল শিরিন। অনেকক্ষণ পরে, আরো খানিক সাহস সঞ্চয় করে একটা হাত রেখেছিল আমাদের ওপর। ফিস ফিস করে জিগ্যেস করেছিল, আপনি আমাকে সন্দেহ করেন কেন?
কোন উত্তর দেয়নি সামাদ। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন না?
সামাদ নিশ্চুপ।
আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই, কেউ ছিল না।
সামাদ তবু নিরুত্তর। তার চোখ দুটো আগের মতোই বোঁজা।
শিরিন তখন বলেছিল, কেন আপনি এ রকম করেন? আমাকে বলতে পারেন না?
তখন পাশ ফিরে শুয়েছিল সামাদ, শিরিনের দিকে পিঠ দিয়ে। শিরিন তখন সামাদের পিঠে হাত রেখেছিল।
আমাকে ঘৃণা করেন?
যেন একটা পাথরের সঙ্গে কথা বলছে শিরিন।
বৌকে ভালোবাসতে হয়, জানেন না বুঝি? আপনি এত লেখাপড়া করেছে, এত বোঝেন, এটা বোঝেন না?
সামাদ তখন উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। শিরিন ভেবেছিল, হয়ত সে এখনি ফিরে আসবে। কিন্তু অনেকক্ষণ বয়ে যাবার পরেও যখন সামাদ এলো, তখন সে নিজেই উঠেছিল।
ঘরের দরোজা খুলে দেখে, পাশে পড়ার ধরে, চেয়ারে বসে আছে সামাদ, সুমুখে ছোট চৌকির ওপর দু পা তুলে দিয়ে।
এখানে বসে আছেন?
একতরফা কতক্ষণ কথা বলতে পারে মানুষ। বাইরে প্রবল প্রবাহিত রাত, নদীর শব্দ, শেয়ালের ডাক। শিরিন হঠাৎ অদ্ভুত এক সাহস পেয়ে যায়। তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের স্মিত হাসি। সে চৌকির ওপর বসে পড়ে। তারপর বলে, আমিও তো বলতে পারি, কোনো মেয়ের দিকে তাকাবেন না। আপনার কলেজে তো কত ছাত্রী আছে?
তারা আমার ছাত্রী। আমি অধ্যাপক।
এই এতক্ষণে একটা উত্তর দেয় সামাদ। কিন্তু সে উত্তর যেন বর্শার মতো তীক্ষ্ণ।
তা হোক। শিরিন ভয় কাটিয়ে উঠেছে।
ছাত্রীদের দেখে আপনার কোনো ইচ্ছে হয় না?
না।
কেউ একা আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসে না?
না।
তাদের কাউকে আপনার পছন্দ হয় না?
না।
কেন হয় না? তারা সুন্দরী না? আমার মতো বুক তাদের নেই? আমার মতো হাত-পা? আমার মতো চুল? আমার মতো শরীর?
শিরিন নিজেই বুঝতে পারেনি যে, প্রতিটি প্রশ্নে তার গলার পর্দা চড়ে যাচ্ছিল, চিৎকার করছিল সে। বুঝলো তখন, যখন প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল সামাদ তার গালে।
সমস্ত মুখটাতে যেন আগুন ধরে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে সামাদ শুধু বলল, শরীর দিয়ে আমাকে কেউ ভোলাতে পারে —এই কথাটা জেনে রেখো।
পরদিন, সারাদিন বিছানায় শুয়ে রইল শিরিন। রান্না করল না, খেল না; সামাদকেও না খেয়ে থাকতে হতো, কিন্তু সে বেরিয়ে গিয়ে সন্দেশ, পরোটা, দুধ বাজার থেকে কিনে এনে পড়ার টেবিলে বসে বসে খেল। এত নিরুদ্বেগভাবে সে খেল, যেন বাড়িতে দ্বিতীয় কেউ না খেয়ে নেই। অনেক রাত পর্যন্ত রেডিও শুনলে সে তারপর বিছানায় এসে শীতল কঠিন গলায় আদেশ করল, গোসল করে এসো।
গা কেঁপে উঠল শিরিনের। হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল, কেউ মরে গেলে তাকে গোসল করিয়ে মাটি দিতে হয়।
সামাদ কি তাকে খুন করে মাটির তলায় আজ কবর দিতে চায়?
যাও বলছি।
সম্মোহিতের মতো শিরিন উঠে বসলো। একবার ভয়ার্ত চোখে তাকাল স্বামীর দিকে।
গোসল করতে যাও।
রান্নাঘরের পাশে কুলগাছের নিচে পাতকুয়ো। অন্ধকার কুলগাছটা কংকালের হাতের মতো ডালপালা ছড়িয়ে আছে। তারই তলায় ঝপ ঝপ করে গোসল করল শিরিন। আতংক যখন মানুষকে সম্পূর্ণ অধিকার করে নেয়, আতংকের বোধ তখন থাকে না। গোসল সেরে বারান্দায় উঠে এলো শিরিন। সমস্ত গায়ে ভিজে কাপড় সপ সপ করছে তার।
সেই কাপড়েই ভেতরে এলো সে। শুকনো কাপড়ের জন্যে আলনায় হাত বাড়াতে যাবে, বিছানা থেকে সামাদের কণ্ঠ, যেন রেডিওর মতো ধাতবকণ্ঠ শোনা গেল।
টেবিলে দুধ আছে। খেয়ে নাও।
এক মুহূর্ত ইতঃস্তত করল শিরিন। ভিজে কাপড়েই দুধ খাবে, না, কাপড়টা ছেড়ে নেবে আগে?
খেয়ে নাও।
বিষের মতো ঠাণ্ডা দুধ, সমস্ত গেলাশ নিঃশেষ করে পান করল শিরিন। তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইল ঘরের মাঝখানে। যেন সে নিজে নয়, অন্য কেউ এই মাঝরাতে গোসল করেছে, দুধ খেয়েছে, দাঁড়িয়ে আছে—আর সে নিজে বহুদূর থেকে স্মিতমুখে এ সবই প্রত্যক্ষ করছে।
কাছে এসো।
ভিজে কাপড়েই একবার বিছানার দিকে পা বাড়ায় শিরিন। কিন্তু কাপড়ে সপ করে একটা আওয়াজ উঠতেই সে থামে। আস্তে আস্তে ছেড়ে ফেলে শাড়ি। স্বামীর সুমুখে কোনোদিন সে যে শাড়ি পাল্টায়নি, সে রকম ভাবতেও পারে না, সেটা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে আজ শিরিন। শাড়ি ছাড়ল, জামা ছাড়ল, সায়া ছাড়ল, সমস্ত শরীরে সিক্ততা নিয়ে আলনায় কাপড়ের দিকে হাত বাড়াতে যাবে এমন সময় সামাদ ডাক দিল, তার নাম ধরে ডাক দিল, দিনের মধ্যে এই প্রথম।
শিরিন।
লণ্ঠনের স্তিমিত আলোয় এই প্রথম সে নিজের নগ্নতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল বিদ্যুতের মতো তীব্র দ্রুতগতিতে। তাড়াতাড়ি হাত বাড়াল শাড়ির দিকে, আর ঠিক তক্ষুণি বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সামাদ। শিরিনের বুকের কাছে দলা করে চেপে ধরা শাড়িটাকে প্রবল শক্তিতে টেনে ছুঁড়ে ফেলে সামাদ তাকে নিজের বুকে ঠেসে ধরল মরণপণ মত্ততার সঙ্গে।