কেন আমাকে আপনি বলো?
জানি না।
কাউকে তুমি বলতে ইচ্ছে হয় না তোমার?
সামাদ চাপা গর্জন করে ওঠে।
বলল, ইচ্ছে হয় কি–না। কোনো পুরুষকে? আমার চেয়ে সুন্দর, আমার চেয়ে বিদ্বান, আমার চেয়ে স্বচ্ছ কোনো পুরুষকে?
না–না, না।
চিৎকার করে ওঠে শিরিন।
চুপ। চেঁচিও না। বেশ্যার মতো চেঁচিও না।
লুও কণ্ঠ নামায় না শিরিন। আগের মতই চিৎকার করে বলে, আমি কাউকে চিনি না, কাউকে জানি না, আমাকে আপনি মেরে ফেলুন, আমাকে আপনি মারুন।
বলতে বলতে প্রথমে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শিরিন। তারপর মুচ্ছা যায়। অনেকক্ষণ পর বুকের ওপর প্রচণ্ড একটা ভার টের পেয়ে চিৎকার করে উঠতে গিয়েই শিরিন জেনে যায়, সামাদ তার শরীর ভেতর প্রবিষ্ট হয়ে উল্লাসের মতো আছড়াচ্ছে। বাইরে অবিরাম নদীর পাড় ভাঙ্গার শব্দ শোনা যাচ্ছে, ঠিক যেখানে খাল এসে নদীতে মিলেছে।
এতদিন ছিল একরকম, এখন হলো আরেকরকম। এতদিন সামাদের প্রশ্নগুলোতে বিশেষ কোন ব্যক্তির উল্লেখ ছিল না। একদিন হঠাৎ একজনের নাম এসে গেল। ইতিহাসের অধ্যাপক করিম সাহেব একদিন রাতে এসে হাজির হয়েছিলেন। না, গল্প করতে আসেননি তিনি। বিয়ের পর থেকে শিরিন দেখে এসেছে সামাদের কাছে কেউ কোনোদিন গল্প করতে আসে না। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। আর সেটা সামাদের তন্ময় গভীর স্বভাবের জন্যে বলেই মনে করে এসেছে শিরিন।
করিম সাহেব এসেছিলেন বিপদে পড়ে। নিকট প্রতিবেশী তিনি। তার স্ত্রীর হঠাৎ ব্যথা উঠেছে। গর্ভের সাড়ে ছমাসের মাথায় ও রকম ব্যথা উঠবার কথা নয়।
আপনার মিসেস একবার আসতে পারবেন?
ঘটনা আড়াল থেকে শুনে দরোজার ওপারে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো শিরিন। করিম সাহেব টের পান না, সামাদ টের পেয়েছিল তার উপস্থিতি।
সামাদ বলেছিল, আমার স্ত্রীর এ সবের কি বুঝবে করিম সাহেব? তার তো বাচ্চা হবার অভিজ্ঞতা নেই। আপনি বরং প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের বাসায় যান।
হ্যাঁ, তা বটে। সেই ভালো। আমি ভেবেছিলাম–বলতে বলতে করিম সাহেব দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলেন, সম্ভবত প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের বাসার দিকেই।
আর সামাদ উঠে দাঁড়িয়ে দরোজার আড়াল থেকে খপ করে টেনে সামনে এনেছিল শিরিনকে।
কি, যেতে চেয়েছিলে? করিম সাহেবের বাসায়?
ওর বৌ কষ্ট পাচ্ছে।
তুমি গিয়ে কষ্ট কমাতে পারতে? তুমি ডাক্তার? না, নার্স? না, দাই? যে তুমি ওসব বোঝো?
তবু একটা লোক থাকলে, কাছে থাকলে—
কথাটা শিরিন শেষ করতে পারেনি।
সামাদ তার হাত প্রায় মুচড়ে ধরে বলেছিল, কাছে থাকলে। কার কাছে? করিম সাহেবের কাছে তুমি থাকলে? বৌ তো ব্যথায় কারাচ্ছে। সেই অবসরে করিম সাহেবের কাছে থাকার সুন্দর একটা সুযোগ, কি বলো?
ছিঃ। বলে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল শিরিন।
মনে যা ভাবছ, আমি মুখে বললেই ছিঃ।
হাতটা মুচড়ে ব্যথা করে দিয়েছিল সামাদ। অনেকদিন পরে সে রাতে স্পর্শ করে নি সামাদ, যেমন সে প্রতিদিন করত, বিছানার একপাশে সন্তর্পণে গা বাঁচিয়ে চিৎ হয়ে শুয়েছিল।
এতে অবাকই হয়েছিল শিরিন। লোকটাকে এই এক বছরেও সে এতটুকু বুঝতে পারে নি।
এর, কয়েকদিন পরে, বাটনা বাটছিল শিরিন আর সমুখে বসে আনাজ কাটছিল আলী। এমন সময় সামাদ কলেজ থেকে ফিরে আসে। খুব কমই এমন সময়ে সে ফেরে। তাই উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েছিল শিরিন; ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বুক থেকে আঁচল খসে পড়েছিল। আর অন্যদিকে, সাহেবকে ফিরতে দেখে আলী তার ঝকঝকে সব কটা দাঁত বের করে নিঃশব্দে একবার হেসেছিল।
ঘটনা এই। কিন্তু বিচ্ছিন্ন সম্পর্কহীন কতগুলো অংশ জোড়া দিলে যে সম্পূর্ণ একটা বৃত্ত আঁকা যায়, শিরিন সেটা বুঝেছিল একটু পরেই।
ঘরে এসো। সামাদের শীতল কঠিন স্বর।
ঘরে এসে দাঁড়াতেই সামাদ বলেছিল, ভাবোনি এখন আমি আসব। ভেবেছ, আসবো সেই সন্ধ্যের পর। না?
হ্যাঁ। আপনি তো সন্ধ্যের আগে আসেন না।
আর তাই বুকের কাপড় ফেলে হলুদবাটছিলে আলীর সামনে?
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল শিরিন।
বলো বাটছিলে কি–না?
হ্যাঁ, বাটছিলাম।
বুকের কাপড় পরে গিয়েছিল?
শিরিন কোনো উত্তর দেয়নি।
গিয়েছিল কি–না? বলল, গিয়েছিলো কি-না?
লক্ষ্য করিনি।
হঠাৎ মনের মধ্যে দুঃসাহস জেগে উঠে শিরিনের। এই প্রথম। পায়ের নিচে নরম কাদার বদলে শুকনো খটখটে মাটি যেন টের পায় সে।
লক্ষ্য করো নি?
না, করি নি।
কেন, করো নি?
আপনার মতো ছোটো মন আমার নেই বলে।
কথাটা বলেই চলে যাচ্ছিল শিরিন, খপ করে তার হাত ধরে টেনে এনে সামাদ ফেলে দিয়েছিল তাকে খাটের ওপর। খাটের একটা কোণে শিরিনের মাথাটা ঠুকে গিয়েছিল। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল তপ্ত পাথরের মতো একখণ্ড ভয়াবহ ব্যথা।
আমার ছোটো মন? আর তোমার মন উদার? লজ্জা করে না, একটা বাচ্চা ছেলেকে শরীর দেখাতে?
মূর্চ্ছিত হয়ে গিয়েছিল বলেই স্বামীর বাকি কথাগুলো শুনতে পায়নি শিরিন।
জেগে উঠে দেখে ঘরের এককোণে লণ্ঠন জ্বলছে। কেউ মরে যাবার মতো করুণ একটা রাত নেমেছে।
চোখ মেলে তাকাতেই সামাদ বলেছিল, নাও, ওঠো রান্না করো, খিদে পেয়েছে। আলীকে বের করে দিয়েছি। সে চলে গেছে।
সেদিন রাতেও সামাদ তাকে স্পর্শ করেনি। সেই আরেকদিনের মতো সে বিছানার একপাশে সরে গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থেকেছে।
হঠাৎ একটা কথা মনে হয়েছিল শিরিনের। যখনই কোনো ব্যক্তির উল্লেখ হয়, সামাদ আর তাকে স্পর্শ করে না।