ঘরের ভেতর আলী তখন এসে পড়ায় বেঁচে গিয়েছিল শিরিন। আলী জানতে এসেছিল, রান্না শেষ। গরম গরম খেয়ে নিলেই ভালো।
আলী চলে যেতেই শিরিন বলেছিল, আলী দেখে ফেলল। কি ভাবল?
কিছু ভাবেনি। বয়স হলেও আলীর বুদ্ধিটা বাচ্চা ছেলের মতো। সেই জন্যেই ওকে রেখেছি।
মাত্রা কয়েকদিনের ভেতরেই শিরিন টের পেয়ে গিয়েছিল যে সামাদ যা করে। তা ভেবে চিন্তেই করে। তার সমস্ত কিছুরই পেছনে আছে গাঢ় ভাবনা, গভীর সিদ্ধান্ত। সে ভাবনার হদিশ পায় না শিরিন। সে সিদ্ধান্ত বিকট নিষ্ঠুর মনে হয় তার।
মানুষটা দিনের বেলায় যেন ভিন্ন রকম মনে হয়। রাতের অন্ধকারে চারদিক থেকে যে দেয়াল গড়ে ওঠে দ্রুত, দিনের আলোয় তা যেন খসে যায়। খুব ভোরে উঠে খালের পাড় ধরে হাঁটতে বেরোয় সামাদ। মাথা উঁচু করে কাধ সোজা করে, বড় বড় করে পা ফেলে সামাদ রোজ সকলে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়। রোজ সকালে শিরিন এই দৃশ্যটা জানালা দিয়ে চুপি চুপি দেখে, যেন প্রতিদিনই এই তর্কের মীমাংসা খুঁজতে যে, লোকটি একটি লোক কিনা। তারপর সামাদ যখন ফিরে আসে শিরিনের গোসল সাড়া হয়েছে। রোজ সকালে গোসল করে শিরিন; কারণ, সামাদ তাকে কোনো রাতেই রেহাই দেয় না। প্রতি রাতে তাকে সে অধিকার করে নেয় ভয়াবহ দ্রুততার সঙ্গে, ক্রোধের সঙ্গে, অন্তহীন সন্দেহের রশিতে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে।
স্বামীর দ্বিতীয় কোনো অনুভূতির সংবাদ পায় না শিরিন। এমন কি সে কি খেতে ভালোবাসে, কলেজে কি পড়ায়, কত মাইনে পায়, তার আত্মীয় কে কি করে বা তারা কোথায় আছে—এইসব সাধারণ প্রশ্নগুলোরও স্পষ্ট কোনো উত্তর শিরিন সংগ্রহ করতে পারেনি।
বিয়েটা নিতাই তাড়াহুড়ো করে দিয়েছিলেন শিরিনের বাবা-মা। ঘরে যাদের সাত মেয়ে, তাদের অতো বেছে চলতে নেই।
খাল পার থেকে ফিরে এসেই সামাদ নাস্তার জন্যে হাঁক পাড়ে। নাশতা এগিয়ে দেয় আলী। শিরিনের দায়িত্ব শুধু পেছনে দাঁড়িয়ে স্বামীকে হাতপাখার বাতাস করা।
সামাদ কথা বলে আলীর সঙ্গে।
আলী, এতগুলো নৌকা হঠাৎ কোত্থেকে এলোরে? কিংবা দেখে এলাম, বড় বড় মাছ নিয়ে জেলেরা যাচ্ছে, বাজারে দেখিস তো সস্তায় একটা রুই মাছে ল্যাজ পাওয়া যায় কিনা অথবা পরীক্ষার ফল বেরুবার সময় এখন। কোনা ছাত্রটা যেন বাড়ির কাছে না ভেড়ে।
মনিবে-চাকরে কথা হয়। শিরিনের মনে হয়, গোপনেও তাদের শলা-পরামর্শ চলে। কতদিন শিরিন দেখেছে বাসা থেকে বেরুবার মুখে যে জামগাছ, তার তলায় সতর্ক গলায় সামাদ কি যেন বলছে আলীকে।
কিন্তু সে খবর নেবার মতো সাহস পায় না শিরিন। আসলে, এ বাড়িতে আসবার পর থেকে নিজের ভেতরে একটি জিনিসের ক্ষয় সে অসহায় চোখে দেখছে, তা তার বুকের ভেতরকার সাহস।
সারাদিন কলেজে পড়ে থাকে সামাদ। ঠিক সন্ধের সময় প্রতিদিন যখন সে ফিরে আসে, তখন দুয়ারে পা দেবার মুহূর্ত থেকেই সামাদের চোখে সেইপ্রথম রাত্রে মর্মভেদি শীতল দৃষ্টি দেখতে পায় শিরিন। সে দৃষ্টি তাকে সর্বত্র অনুসরণ করে; এমন কি দৃষ্টির আড়ালে গেলেও মনে হয় সে দৃষ্টি তার পিঠে বিধে আছে সেফটিপিনের তীক্ষ্ণ ডগার মতো।
দিনের বেলায় যে মানুষটিকে মনে হয় স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে কৃতসংকল্প, অধ্যাপনার দায়িত্বে একনিষ্ঠ, বইয়ের পাতায় তন্ময়, প্রকৃতির ঋতুবদলের উৎসাহী সংবাদ। সংগ্রাহক, গ্রামে যে কোনো নতুন ঘটনায় কৌতূহলী, সেই মানুষটিকে লণ্ঠন জ্বালা অন্ধকারে, শেয়ালের যোজন পেরুনো অন্ধকারে মনে হয় একখণ্ড জ্বলন্ত সহিংস উলকার মতো ধাবমান পাথর।
রাতের আহার সব সময়েই নিঃশব্দে শেষ করে সামাদ। এমনভাবে থালার ওপরে ঝুঁকে পড়ে ভাত খায়, মনে হয় যেন শতাব্দীপ্রাচীন কোনো গ্রন্থ পাঠ করছে। আলী রাতের বেলায় চোখে দেখতে পায় না বলে, রাতের আহার পরিবেশন করে শিরিন। বারান্দার শেষ প্রান্তে খেজুরের পাটিতে ঘুমিয়ে থাকে আলী। অখণ্ড নীরবতার ভেতরে আহার শেষ করে সামাদ চোখ বুজে রেডিও শুনতে বসে। দাঁড়িয়ে শিরিন ঘুমে ঢুলতে থাকে। বিছনায় যেতে না বলা পর্যন্ত শুতে যাবার সাহস হয় না তার।
তারপর হঠাৎ এক সময়ে চোখ তুলে হয়ত তাকাল সামাদ। কৃত্রিম একটা ঝিলিক নিজের দু’চোখে এনে সহাস্য কন্ঠে কোনোদিন জিগ্যেস করে, খুব সাজগোজ করা হয়েছে যে।
সাজগোজ কোথায়? নতুন শাড়িটা পরেছে মাত্র। কোনো না কোনোদিন থেকেই তো নতুন একটা শাড়ি পরা শুরু হয়, তারপর সেটা পুরোনো হয়ে যায়। কিন্তু এটাকেই কোনো প্রকারে অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে সামাদ।
ব্যাপার কি?
কই, কিছুনা।
কেউ এসেছিল? না, কোথাও গিয়েছিলে?
আপনাকে না জিগ্যেস করে কোথাওতো যাই না।
সামাদ হঠাৎ রেডিও বন্ধ করে দেয়। হঠাৎ যেন বলবান এক নিস্তব্ধতা শিরিনের দুকাধ চেপে ধরে। পরক্ষণেই শিরিন টের পায়, সামাদ তাকে বাধ্বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে।
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সামাদ বলে, জিগ্যেস না করেও যাওয়া যায়। আমি তো আর সারাক্ষণ তোমাকে পাহারা দিয়ে রাখি না।
তারপর হঠাৎ শিরিনকে কোলপাজা করে নিয়ে যায় শোবার ঘরে। দড়াম করে খাটের ওপর শুইয়ে দিয়ে, শিরিনের মুখের ওপর মুখ এনে প্রশ্ন করে, আমাকে তুমি এখনো আপনি বলো কেন?
কি জবাব দেবে এ প্রশ্নের? শিরিন দেখে এসেছে তার মা ও বাবাকে আপনি বলে ডেকেছেন সারাজীবন। সেটাই নিয়ম বলে জেনে এসেছে সে। গল্প উপন্যাসে স্বামী স্ত্রী যে পরস্পরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে থাকে, সেটা শিরিনের কাছে সব সময়ই ভিন্ন কোনো জগতের বলে মনে হয়েছে।