- বইয়ের নামঃ সৈয়দ শামসুল হকের গল্প
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
গন্তব্য, অশোক – সৈয়দ শামসুল হক
ধরো, আমার কোনো বন্ধু তোমার দিকে তাকালে আর তোমার মনে হলো, তুমি উলঙ্গ হয়ে যাচ্ছো, আঁচল পড়ে যাচ্ছে, বোতাম ছিঁড়ে যাচ্ছে, তখন তুমি কি করবে?
এখনো বিশ্বাস হতে চায় না যে বিয়ের রাতেই সামাদ, তার স্বামী, এ ভয়াবহ প্রশ্নটা করেছিল। বলল, তুমি কি করবে?
সোনালী ফোঁটায় সজ্জিত শিরিনের মুখ জোর করে তুলে ধরে, তার চিবুক সাঁড়াশির মতো ঠেসে ধরে হিস হিস করে সামাদ জানতে চেয়েছিল। ব্যথায় টনটন করে উঠেছিল চিবুক, আর প্রশ্নটা তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
তখনো স্বামীকে সে ভালো করে দেখেনি। শুধু নামটা শোনা ছিল, আর একটা ফটো দেখেছিল। শুধু জানতো যে তার স্বামী কালীগঞ্জ কলেজের অধ্যাপক, যে কালীগঞ্জে যেতে হয় লঞ্চে করে।
বলো, কি করবে?’ সামাদ তাকে সজোরে পেছনে ঠেলে দিয়ে একরোখার মতো জানতে চেয়েছিল। কি করবে তুমি শিরিন?
বিয়ের সন্ধে থেকে শিরিনের ভিতরটা অবিরাম দপ দপ করছিল তার স্বামী, একটি পুরুষের স্পর্শ প্রতীক্ষা করে, কোনদিন লঞ্চে সে চড়েনি, সেই লঞ্চে যাত্রা করবার কল্পনা করে। সে ছিল এক ধরনের ভয়, যে ভয়, ভয় দেখায় না, যে ভয়ের। খুব কাছে যেতে কেবলি ইচ্ছা হয়।
বলো, উত্তর দাও।
স্বামীর হাতে ধাক্কা খেয়ে বালিশের ওপর, বালিশে ছড়ানো ফুলের পাপড়ির ওপর পড়ে যেতে যেতে সেই প্রথম তাকে ভালো করে দেখেছিল শিরিন।
কিন্তু ভালো করে কি দেখা গিয়েছিল? বাসরঘরে জ্বলছিল লণ্ঠন। সে লণ্ঠন সামাদ নিজেই স্তিমিত করে দিয়েছিল খাটে উঠে আসবার সময়। ভালোই করেছিল। শিরিন জানতো, তার বোনেরা, তার সইয়েরা আড়ি পেতে থাকবে, টিনের বেড়ার ফোকর দিয়ে চোখ চালাতে চাইবে।
হ্যাঁ, সেই অস্পষ্ট আলোতেও সামাদকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল। আর তৎক্ষণাৎ শিরিন মর্মে মর্মে টের পেয়েছিল যে, সামাদ পরিহাস করছে না প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত প্রশ্নটা সে করতেই থাকবে।
বলো, কি করবে? তখন সেই বন্ধুর সম্মুখ থেকে তুমি সরে যাবে? না, তার গালে একটা প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দেবে?
সামাদের মুখ তখন নেমে এসেছিল শিরিনের ওপর; এত কাছে যে, তার নিঃশ্বাসের হলকা শিরিনের মুখের ওপর অদৃশ সরীসৃপের মতো খেলা করতে শুরু করেছিলো।
নিঃশ্বাসের হলকা ওড়াতেই শিরিন চোখ বুজে সেই প্রথম বলেছিল, এমন বন্ধু আপনার কেউ আছে বুঝি?
ঐ সামান্য ক’টা শব্দ উচ্চারণ করতে যে এতখানি শক্তির দরকার হতে পারে শিরিন সেটা বুঝেছিল পরমুহূর্তেই। কথাগুলো বলে সে হাঁপিয়ে উঠেছিল যেন একমাইল দৌড়ে গেছে।
সেই কি দূরত্ব সৃষ্টির শুরু। কেবল মাইলের পর মাইল দূরে সরে যাবার শুরু।
বাহ, এইতো কথা বলতে পারো দেখছি। বোবা নও, কালাও নয়। তাহলে এতক্ষণ দেরি করছিলে কেন উত্তর দিতে?
সামাদ তাকে কঠিন দুহাতে ঠেসে ধরে কানের কাছে চাপা চিৎকার করে উঠেছিল, বলো, এতক্ষণ উত্তর না দিয়ে কি ভাবছিলে? ভাবছিলে, দেখুক তোমাকে? ভাবছিলে, ভালোই তো কেউ যদি দেখে? না। তুমি আমার, শুধু আমার। বুঝেছ? আমার।
একটানে বুকের কাপড় সরিয়ে হঠাৎ কামড় বসিয়ে দাঁতের ভেতরে মাংস রেখে সামাদ তখন অবিশ্রান্ত বলে চলেছিল, তুমি আমার, তুমি আমার।
তারপর কালীগঞ্জ। সেই চারদিকে খাল-বিল আর নদীর মাঝখান, বারো মাসের প্লাবনের মাঝখানে ছোট্ট এক শহরে কলেজের প্রান্তে সেই বাসায় আসা। বাসাতে শুধু তারা দুজন। আর মাথায় লম্বা, বুদ্ধিতে খাটো এক কাজের ছেলে। বিয়ের আগে থেকেই সে আছে। এতকাল সেই রান্না করেছে, ঘর দেখেছে, সেবা করেছে সামাদের।
সামাদের হাত ধরে শিরিন যখন এ বাসায় পা দিয়েছিল, তাকে ঘরে তুলতে এসেছিল জনা তিনেক অধ্যাপকের স্ত্রী। তারা কোনমতে শিরিনকে শোবার ঘর পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে, একটুখানি বসেই বলেছিল, যাই ভাই। আমাদের সংসার পড়ে আছে।
শিরিন চোখ তুলে দেখতে পেয়েছিল, দরোজার বাইরে, বারান্দার খাটের খামে ঠেস দিয়ে, অন্ধকারে নিঃশব্দে সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসছে আলী—সেই কাজের ছেলেটি। একটা শেয়ালের ডাক কত যোজন পেরিয়ে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম হয়ে কানের ভেতর দিয়ে, হৃদয়ের সেই কুঠুরিতে যেখানে ভয় থাকে বাসা করে, সেখানে আছড়ে পড়ছিল অবিরাম।
সে রাতে শিরিন ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করেছিল, আপনার কোনো বন্ধুকে দেখলাম।
দেখতে চাও?
না।
হঠাৎ শিরিনের মনে পড়ে গিয়েছিল, এ প্রশ্নটার পেছনে অন্য কোন কিছু দেখতে পারে সামাদ।
দেখতে চাও আমার বন্ধুদের? দেখতে ইচ্ছে করে? দেখবে তাদের?
না। না।
কেন দেখবে না? কেন দেখতে চাও না? ভয় করে? লোভ হয়? বলো, লোভ হয় কিনা?
একটানে শিরিনকে বুকের কাছে টেনে সামাদ আবার সেই চাপা চিৎকার করে জানতে চায়, বলো, আমাকে বলো, বলো।
তারপর আবার সেই কামড়। সেই তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে দেয়া—এবার শিরিনের কাঁধে। আর মুখের ভেতরে কাপড় আর মাংস নিয়ে বোবার মতো আবার সেই গোঙ্গানি।
না, কেউ না; কোনদিন না, কক্ষনো না।
দরোজার কাছে আলী যখন ডাক দিয়েছিল, সাহেব, তখনো কাঁধ থেকে মুখ সরায়নি সামাদ। শিরিনই তাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সামাদ যেন আগুনের মতো দপ করে উঠেছিল, মুহূর্তে হাত উঠিয়েছিল মাথার ওপরে, যেন প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আঘাত করতে এক্ষুণি নেমে আসবে সে হাত।