ছেলেবুড়োয় সং সাজিয়ে
রং লাগিয়ে গান ধরেছে—
তারা বানিয়ে জটা লাগিয়ে আঠা
দাড়ি গোঁপে খুব সেজেছে।
আবার খেল্কা পরে হল্কা ধরে
মাজা নেড়ে খুব নাচিছে—
এ সকল উপরি চটক আল্গা ভড়ক
করে বলো ফল কী আছে?
বলা বাহুল্য এমন সাজানো, দলের বানানো গানের ঢেউ বেশিদিন চলেনি। সমকালীনরাও এমনকী একে ‘সং’ বলে চিহ্নিত ও পরিহাস করেছিল। গানের নামে এ যে গিমিক, ‘উপরি চটক’ ও ‘আলগা ভড়ক’ (অর্থাৎ ভড়কি) এবং শেষ পর্যন্ত এ প্রচেষ্টা যে নিষ্ফল তা ঘোষণা করতে সেকালের প্রাজ্ঞ বিবেকীদের সংশয় ঘটেনি। তা হলে আজ আমরা কেন এত উদাসীন ও অপারগ?
বাউল গানের নামে গেরুয়ার বিলাসিতা, সাজসজ্জা কেশবিন্যাসের ঘটা অথবা সাঁইবাবার মতো চর্চিত কেশের মাথা ঝাঁকানো কবে শেষ হবে? চোখের সামনে দেখছি, বাউলদের পাশে আসরে পাত্তা পাবার জন্য যুবক বয়সের ফকিরিগানের গায়ক সাদা পোশাক ছেড়ে পরছে কালো রঙের আলখাল্লা, গলায় পরছে নানা বর্ণের পাথরের মালা। চারপাশে জুটে গেছে নানা ধরনের গীতিকার— তারা সাধকও নয়, তাত্ত্বিকও নয়— গানের সরবরাহকারী। সরকারি আমলা, সভাধিপতি, লোকসংস্কৃতিগবেষক, বিধায়ক, বাউল সমাবেশের উদ্যোক্তা এমনকী মন্ত্রীদের কাছে গিয়ে তারা বিনয়বচনে জানায়, সব রকমের বাউলগান তারা লিখেছে, লিখে দিতে পারে। সাক্ষরতা, বয়স্ক শিক্ষা, পণপ্রথা বিরোধী, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সংহতি, মৌলবাদবিরোধী, চাইকি থ্যালাসেমিয়া ও এড্স্ নিয়ে তার লেখা গান আছে। সে সব গান নিয়মিত গেয়েছে, গায়, অমুক বাউল তমুক বাউল। গান চাই গান? কে নেবে গো বাউল গান!
আজ তাই সারা পশ্চিমবাংলার বাউল ও ফকিরদের বৃত্তান্ত লেখার চেষ্টা করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, প্রথমে গত শতাব্দীর আগে থেকে এদেশে বাউল ফকিরদের নিয়ে যে সব চিন্তাভাবনা ছাপা বইতে লিখিত আকারে পাওয়া গেছে তার ধারাবিবরণ জানা জরুরি। মনে রাখতে হবে এসব রচনা হয়তো ছিল নিতান্ত ক্যাজুয়াল। তত কিছু গূঢ় গভীর সন্ধান করে সবাই লেখেননি, এসে গেছে লেখার টানে। কেউ কেউ আবার একটু গভীরে যেতে পেরেছেন। কেউ বাউলদের বিরোধী, কেউ দরদি। তবে দৃষ্টিকোণ যাই হোক, প্রান্তীয় বা উদার, ইতিহাসের প্রয়োজনে আমাদের জানতে হবে এই বৃত্তান্ত রচনার আগে কে কেমন ভেবেছেন নিম্নবর্গের এই গৌণধর্মীদের জীবন আর সাধনা নিয়ে। তার জন্য নানা রকম বইপত্র, পুথি, পুস্তিকা, পত্রিকা ও চিঠি থেকে উৎকলন সহযোগে জেনে নিতে হবে এর পরে।
১.৩ গোপ্য সাধনার ত্রিবেণী