- বইয়ের নামঃ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা – দ্বিতীয় খণ্ড
- লেখকের নামঃ স্বামী বিবেকানন্দ
- বিভাগসমূহঃ রচনাবলী
০১. জ্ঞানযোগ
০১. মায়া
(লণ্ডনে প্রদত্ত বক্তৃতা)
‘মায়া’ কথাটি আপনারা প্রায় সকলেই শুনিয়াছেন। সাধারণতঃ কল্পনা বা কুহক বা এইরূপ কোন অর্থে মায়া-শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে, কিন্তু তাহা উহার প্রকৃত অর্থ নহে। মায়াবাদ-রূপ অন্যতম স্তম্ভের উপর বেদান্ত স্থাপিত বলিয়া মায়ার যথার্থ তাৎপর্য বুঝা আবশ্যক। মায়াবাদ বুঝাইতে হইলে সহসা হৃদয়ঙ্গম না হইবার আশঙ্কা আছে, এজন্য আপনারা কিঞ্চিৎ ধৈর্যের সহিত শ্রবণ করিবেন, ইহাই আমার প্রার্থনা।
বৈদিক সাহিত্যে কুহক অর্থেই মায়া-শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। ইহাই মায়া-শব্দের প্রাচীনতম অর্থ। কিন্ত্তু তখন প্রকৃত মায়াবাদের অভ্যুদয় হয় নায়। বেদে আমরা এইরূপ বাক্য দেখিতে পাই, ‘ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরূরূপ ঈয়তে’-ইন্দ্র মায়া দ্বারা নানা রূপ ধারণ করিয়াছিলেন। এস্হলে মায়া-শব্দ ইন্দ্রজাল বা অনুরূপ কোন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। বেদের অনেক স্থলে মায়া-শব্দ ঐরূপ অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে দেখা যায়। অতঃপর কিছুদিনের জন্য মায়া-শব্দের ব্যবহার সম্পূর্ণ লুপ্ত হইয়া গেল। কিন্ত্তু এই অবকাশে ঐ শব্দ-প্রতিপাদ্য ভাব ক্রমশই পরিপুষ্ট হইতেছিল। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়,প্রশ্ন করা হইতেছে, ‘আমরা জগতের গুপ্ত রহস্য জানিতে পারিনা কেন?’ ইহার এইরূপ গভীরভাবব্যজ্ঞক উত্তর পাওয়া যায়, ‘আমরা জল্পক, ইন্দ্রিয়সুখে পরিতৃপ্ত ও বাসনাপর বলিয়া এই সত্যকে নীহারাবৃত করিয়া রাখিয়াছি’-‘নীহারেণ প্রাবৃতা জল্প্যা চাসুতৃপ উকথশাসশ্চরংতি!’১ এস্থলে মায়া-শব্দ আদৌ ব্যবহৃত হয় নাই, কিন্তু উহাতে এই ভাবটি পরিস্ফুট হইতেছে-আমাদের অজ্ঞতার যে কারণ, তাহা সত্য এবং আমাদের মধ্যে কুজ্ঝটিকাবৎ বর্তমান।
অনেক পরবর্তী কালে অপেক্ষাকৃত আধুনিক উপনিষদে ‘মায়া’-শব্দের পুনরাবির্ভাব দেখা যায়। কিন্তু ইতোমধ্যে ইহার প্রভূত রূপান্তর ঘটিয়াছে, ইহার সহিত নূতন অর্থ সংযোজিত হইয়াছে. নানাবিধ মতবাদ প্রচারিত ও পুনরালোচিত হইয়াছে; অবশেষে মায়া-বিষয়ক ধারণা একটি নির্দিষ্ট ভাব পাইয়াছে। আমরা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পাঠ করি, ‘মায়ান্তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনন্তু মহেশ্বরম্ ।’-মায়া কেই প্রকৃতি বলিয়া জানিবে এবং মায়ীকে মহেশ্বর বলিয়া জানিবে।
১ ঋগ্বেদ-১০ম মন্ডল, ৮২ সূক্ত, ৭ম ঋক্
মহাত্মা শঙ্করাচার্যের পূর্ববর্তী দার্শনিকগণ এই মায়া-শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করিয়াছিলেন । বোধ হয়, মায়া-শব্দ বা মায়াবাদ বৌদ্ধদিগের দ্বারাও কিছুটা পরিবর্তিত হইয়াছে। কিন্তু বৌদ্ধদিগের হস্তে ইহা অনেকটা বিজ্ঞানবাদে১ পরিণত হইয়াছিল এবং ‘মায়া’ কথাটি এইরূপ অর্থেই এখন সাধারণতঃ ব্যবহৃত হইতেছে। হিন্দু যখন বলেন, ‘জগৎ মায়াময়’, তখন সাধারন মানবের মনে এই ভাব উদিত হয় যে, জগৎ কল্পনামাত্র। বৌদ্ধ দার্শনিকদের এইরৃপ ব্যাখ্যার কিছু ভিত্তি আছে ; কারন এক শ্রেনীর দার্শনিক বাহ্যজগতের অস্তিত্বে আদৌ বিশ্বাস করিতেন না। কিন্তু বেদান্তোক্ত মায়ার শেষ পরিপূর্নরূপ বিজ্ঞানবাদ, বাস্তববাদ২ বা কোন মতবাদ নহে। আমরা কি এবং সর্বত্র কি প্রত্যক্ষ করিতেছি, এই সম্বন্ধে প্রকৃত ঘটনার ইহা সহজ বর্ণনামাত্র।
আপনাদিগকে পূর্বে বলিয়াছি, বেদ যাঁহাদের হৃদয়নিঃসৃত, তাঁহাদের চিন্তাশক্তি মূলতত্বের অনুধাবন ও আবিষ্কারেই অভিনিবিষ্ট ছিল। তাঁহারা যেন এই-সকল তত্বের বিস্তারিত অনুশীলন করিবার অবসর পান নাই এবং সেজন্য অপেক্ষাও করেন নাই।তাঁহারা বস্তুর গভীরতম প্রদেশে উপনীত হইতেই ব্যগ্র ছিলেন। এই জগতের অতীত কিছুই যেন তাঁহাদিগকে আকর্ষণ করিতেছিল, তাঁহারা যেন আর অপেক্ষা করিতে পারিতেছিলেন না। বস্তুতঃ উপনিষদের মধ্যে ইতস্ততোবিক্ষিপ্ত আধুনিক বিঞ্জানে আলোচিত বিশেষ সিদ্ধান্তগুলি অনেক সময়ে ভ্রমাত্মক হইলেও উহাদের মূলতত্ত্বগুলির সহিত বিঞ্জানের মূলতত্ত্বের কোন প্রভেদ নাই। একটি দৃষ্টান্ত দেখানো যাইতেছে। আধুনিক বিঞ্জানের ইথর (ether)বা আকাশ-বিষয়ক অভিনব তত্ত্ব উপনিষদের মধ্যে রহিয়াছে। এই আকাশতত্ত্ব আধুনিক বৈঞ্জানিকের ইথর অপেক্ষা সমধিক পরিপুষ্ট ভাবে বিদ্যমান। কিন্তু ইহা মূলতত্ত্বেই পর্যবসিত ছিল। তাঁহারা এই আকাশতত্ত্বের কার্য ব্যাখ্যা করিতে গিয়া অনেক ভ্রমে পতিত হইয়াছিলেন। জগতের যাবতীয় শক্তি যাহার বিভিন্ন বিকাশমাত্র, সেই সর্বব্যপী প্রাণ-তত্ত্ব বেদে-উহার ব্রাহ্মণাংশেই পাওয়া যায়। সংহিতার একটি দীর্ঘ মন্ত্রে সকল জীবনীশক্তির অভিব্যক্তি প্রাণের প্রশংসা আছে। এই প্রসঙ্গে আপনাদের মধ্যে কাহারও কাহারও হয়তো জানিয়া আনন্দ হইতে পারে যে, আধুনিক ইউরোপীয় বৈঞ্জানিকদিগের মটানুযায়ী এই পৃথিবীতে যে ভাবে জীব-সৃষ্টি হইল,তাহা বৈদিক দর্শনেও পাওয়া যায়। আপনারা সকলেই নিশ্চয় জানেন যে, জীব অন্য গ্রহাদি হইতে পৃথিবীতে আসিয়াছে-এইরূপ একটি মত প্রচলিত আছে। জীব চন্দ্রলোক হইতে পৃথিবীতে আসে-কোন কোন বৈদিক দার্শনিকের স্থির বিশ্বাস।
১ আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সমুদয় জগৎ আমাদের মনেরই বিভিন্ন অনুভূতিমাত্র, উহাদের বাস্তব সত্তা নাই-এই মতকেই বিজ্ঞানবাদ বা Idealism বলে।
২ জগৎ আমাদের মনের অনুভতিমাত্র নহে উহার বাস্তব সত্তা আছে-নাই-এই মতকে বাস্তববাদ বা Realism বলে।