- বইয়ের নামঃ বাউল ফকির কথা
- লেখকের নামঃসুধীর চক্রবর্তী
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০. আত্মপক্ষ – বাউল ফকির কথা
বাউল ফকির কথা – সুধীর চক্রবর্তী
প্রথম সংস্করণ: আগস্ট ২০০৯
.
শ্ৰীঅমিয়কুমার বাগচী
শ্ৰীমতী যশোধরা বাগচী
সৌমিত্রেষু
.
‘বাউল ফকির কথা’ প্রথম প্রকাশিত হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি সংস্কৃতি কেন্দ্র’ থেকে ২০০১ সালের মার্চে। অচিরে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ পায় ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে। ইতিমধ্যে ২০০২ সালে বইটি অর্জন করে আনন্দ পুরস্কার। পরে ২০০৪ সালে পায় সাহিত্য অকাদেমি সম্মান। এরপরে দীর্ঘদিন বইটি দুষ্প্রাপ্য ছিল। এবারে ২০০৯ সালে বইটি প্রকাশিত হল আনন্দ পাবলিশার্সের পক্ষ থেকে। এ ব্যাপারে লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রের সচিব প্রদীপ ঘোষ লিখিত অনুমতিদানে আমাকে বাধিত করেছেন। নবমুদ্রণে বইটির আকারপ্রকার ও বিন্যাস অনেকটা বদলে গেছে, কিছুটা বর্জিত হয়েছে, কিছু যোজিত হয়েছে। প্রচ্ছদ ও আলেখ্যশোভন অন্তর মহলের নতুন ভিস্যুয়াল-ঔজ্জ্বল্য নবসংস্করণকে সমৃদ্ধ করেছে। আনন্দ পাবলিশার্সের সকলকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।
বাংলার বাউল-ফকিরদের নিয়ে এতাবৎকাল যে সব লেখালিখি বা বইপুস্তক বেরিয়েছ, অনেকের ধারণা তথা অভিযোগ যে সেগুলি প্রধানত সাহিত্যগন্ধী কিংবা তত্ত্বগর্ভ। এইসব সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন বাস্তব সামাজিক অবস্থান ও অবস্থা, তাঁদের নিজস্ব আচরণ ও বিশ্বাসের জগৎ, তাঁদের গানের সুর ও সংগীতের মূল্য, তাঁদের প্রতিবাদের প্রক্রিয়া ও বিদ্যমান সমাজাদর্শের প্রত্যাঘাত—এ ধরনের পুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে গেলে তাঁদের সম্পর্কে যে বিস্তৃত ব্যক্তি-তথ্য ও নিরপেক্ষ সারণি থাকা একান্ত আবশ্যিক, আগেকার অন্বেষকরা সে বিষয়ে তেমন ভাবেননি। এর জন্য আমরা অভাববোধ করতে পারি, শোচনা করতে পারি, কিন্তু পূর্বজ সন্ধানীদের দোষারোপ করতে পারি না। ইতিহাসতত্ত্বে যেমন গত দু’-তিন দশক ধরে নিম্নবর্গ-চেতনা বা সাব অলটার্ন দৃষ্টিকোণ এসে তল-থেকে-দেখা ইতিহাসকে উন্মোচন করছে, তেমনই নবলব্ধ ভাবনা সূত্রে বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে খুঁজে নেবার নতুন দিশা যদি কেউ প্রয়োগ করেন তবে বিষয়টি সম্পর্কে ভাববাদের ধূসরতা কেটে যেতে পারে—অবতীর্ণ হতে পারে এমন সব নতুন পর্যবেক্ষণ ও দ্বান্দ্বিক বিন্যাসের ছক যা পালটে দিতে পারে আমাদের বহুদিন পোষিত ধারণাকে। তাই বলে আগের জানাটাও মূল্যহীন হয়ে পড়ে না।
আমি নিজে সত্তরের দশকের কিছু আগে থেকে, কোনওরকম মেথোডলজির বাধ্যতা না নিয়ে, একেবারে নিজের মতো করে গ্রামবীক্ষণ এবং গৌণধর্মী নিম্নবর্গের কয়েকটি উপাসক সম্প্রদায় সম্পর্কে সরেজমিন প্রত্যক্ষণে মন দিই তাঁদের অবস্থানে গিয়ে। সেই কাজ আলতোভাবে বা আলগা ঢঙে গ্রাম্য মেলায় যাওয়া, একটা দুটো গান সংগ্রহের আত্মতৃপ্তি নিয়ে শহরের মননজীবিতায় ফিরে আসা নয়—আমি তাঁদের মধ্যে থেকে, রীতিমতো বসবাস করে অর্থাৎ তাঁদের আহার-সংস্কার-ধূলিতল ও বেদনাতুর জীবনপ্রবাহের অচ্ছেদ্য শরিক হয়ে সবকিছু জানতে বুঝতে চেয়েছি, তাঁদের সঙ্গে বসে তাঁদের গান গেয়েছি। তার ফলে হয়তো গানের ভিতর দিয়ে পৌঁছতে পেরেছি তাঁদের ভাবসত্য ও জীবনবীক্ষণের অনন্য সরণিতে। সেই গানের আবার কত না ধরন, কত না গায়নশৈলী! ক্রমে ক্রমে আমি বুঝতে পেরেছি আসল গান তাঁদের অব্যক্ত সংলাপ, তাঁদের সাংকেতিক তত্ত্বনির্দেশ। সে গানের ক্রম আছে, কোন গানের জবাবে কোন গান, গুরুর সন্নিধানে তারও শিক্ষা এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি আছে। গানের ভিতরের দ্ব্যর্থ এবং অভিসন্ধিত অর্থ বুঝতেও লাগে গুরূপদেশ। আরও আশ্চর্য যে, বাস্তবে দেখেছি, রাঢ়ের বাউল যে-গানটি গাইছেন ঝুমুর অঙ্গের গায়কীতে, সেই একই গান কুষ্টিয়াতে শুনতে পাচ্ছি ভাঙা কীর্তনের ধাঁচে। সেই একই গান আবার উত্তরবঙ্গের বাউলদের গায়নে কিছুটা ভাওয়াইয়া অঙ্গের কাঠামোকে অঙ্গীকার করে নিচ্ছে। শুধু এখানেই বিচিত্রের মর্মবাঁশির শেষ নয়, একই গায়ক সিলেট অঞ্চলের হাসন রজার গান আমাকে শোনান দু’-রকম করে। প্রথমে শান্ত করুণ অত্বর বিন্যাসে—তারপরে ঝোঁক দিয়ে দিয়ে তালের স্পন্দে ছন্দিত করে, যেন কিছুটা হালকা লীলা বিলাসে।
বাংলার নিজস্ব লোকায়তের এমনতর অন্তর্গোপন স্বভাব কেবল তো সুরে বা ঠাটে নেই, আছে সেই জীবনযাপনের দ্বন্দ্বে-ছন্দে, দার্শনিকতায়, সারল্যে ও স্ফূর্তিতে। গানের বেদনার অভিঘাতে যখন আশি-পেরোনো বলহরি দাস বা সত্তর-পেরোনো সনাতনদাস বাউল স্বতই নাচতে থাকেন তখন গানের রূপ ও রস অন্য এক মাত্রায় আমার সামনে প্রতীত হতে থাকে। নাচে-গানে-মেশা একটা আলাদা নৃত্যনাট্যের বাউল-অন্তঃপুর তখন ঝলকে ওঠে—সেই ঝলক দুর্লভ ও বিরলপ্রাপ্য—যেন পাথর আর লোহার সংঘর্ষে চকমকির মতো চকিত ক্কচিৎ স্ফুরণ। বেশ মনে পড়ে, একবার মুর্শিদাবাদের কুমীরদহ গ্রামে এক ফকিরি গানের আসরে, রজনীর নিস্তব্ধ মধ্যযামে, অন্তত আট-দশ জন ফকির তাঁদের গানের তুরীয় অন্তর্লোকের অবগাহনে কেমন উৎক্ষিপ্ত হয়ে নাচছিলেন—মাঝে মাঝেই তাঁদের শরীর ঊর্ধ্বে উঠে যাচ্ছিল নৃত্যবিক্ষেপে। আত্মমগ্ন কিংবা আত্মহারা সেই নাচের উন্মাদনা দেখে কে বলবে যে এইসব ফকির তাঁদের এমন সংগীত-প্রেমের জন্যই গ্রামের গোঁড়া ধর্মসমাজের নির্দেশে নিন্দিত—নিজ গ্রামেই নির্বাসিত। মৌলবাদী ধর্মগুরুর ফতোয়ায় তাঁদের শীর্ণ একতারাও দণ্ডপ্রাপ্ত, তাঁদের কণ্ঠ গানের অপরাধে বিড়ম্বিত।