আমি বললাম, ‘বল আমায় কি করতে হবে।’
উনি বললেন, ‘বহুদিনের চিন্তা ভাবনা আমি তোর মাধ্যমে প্রকাশ করতে চাই।’
আমি বললাম, ‘আমায় কি করতে হবে বল।’
উনি বললেন, ‘তোকে গান শিখতে হবে।’
আমি হাসতে লাগলাম, বললাম, ‘আমার গলা দিয়ে জোরে কথা বের হয় না, আর আমি করব গান?’
উনি বললেন, ‘আমি জানি তোর দাদু গান বাজনা করতেন, তোর ঠাকুমার গলার আওয়াজ কম ছিল না, তোর বাবার গলার তেজ মন্দ নয়, বংশ অনুযায়ী তোরও গান হবে।’
উনি তো বলছেন আর আমি বসে বসে হাসছি। কারণ আমার মনে হত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ খুলে গান করা বড় লজ্জার ব্যাপার। এটা আমার পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব নয়।
দাদু বললেন, ‘তোর কোনও কথাই আমি শুনব না, তোকে প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমার কাছে আসতেই হবে। তোকে প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প শোনাব।’ গল্প শোনার আগ্রহ আমার ছোটবেলা থেকেই। তাই গল্পশোনার আগ্রহে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ওঁর বাড়ি যেতে শুরু করলাম। দাদু গল্প বলা ছাড়াও আধ্যাত্মিক বিভিন্ন আলোচনা করতেন। ওই সব আলোচনা শুনে মনে আমারও আগ্রহ বাড়তে লাগল। হঠাৎ একদিন দেখি একটি লাউ-এর খোলে চামড়া দিয়ে ছেয়ে বাঁশের ছড় বেঁধে একতারা বেঁধে রেখে দিয়েছেন। আমি একতারা দেখে হাসতে হাসতে বললাম, ‘এটা কি হবে?’ উনি বললেন, ‘তোকে শিখতে হবে।’ উনি নিজে বাজিয়ে আমায় শেখাতে লাগলেন। কয়েকদিন পর দেখছি একজনের কাছ থেকে উনি একটা ডুগি চেয়ে রেখেছেন। বললেন, ‘ডানহাতে একতারা আর বাম হাতে ডুগি অভ্যাস করতে হবে।’ ধীরে ধীরে ওই ভাবেই অভ্যাস করতে এবং শিখতে লাগলাম। ঘরের মধ্যে দাদুর কাছে বসে আস্তে আস্তে দু’-একখানা গানও শিখতে লাগলাম। সব গান ওঁর রচনা নয়, নিজে যেগুলো লিখতেন সেগুলিও দিতেন। আমি ওঁর দেওয়া প্রতিটি গানই খাতায় লিখে নিতাম। ওঁর লেখা ও অন্য মহাজনদের লেখা গানে আমার খাতা ভারী হয়ে উঠল। উনি নিজে ভাল বাজাতে জানতেন না তাই পাড়া বা গ্রামে যাঁরা একটু ভাল বাজাতে জানতেন তাঁদের অনুরোধ করতেন আমায় শেখানোর জন্য। ডুগি একতারা বাজাতে গিয়ে বসে বসে হাসতাম। একহাতে একতারা হয়তো বাজত কিন্তু অন্যহাতে ডুগি বাজাতে চাইত না। আর দাদু বলতেন, ‘তোর কোনও কথাই আমি শুনতে চাই না। তোকে শিখতেই হবে।’ তাই সকাল সন্ধ্যায় যখন মন চাইত নির্জনে ওই যন্ত্র বাজানো অভ্যেস করতে লাগলাম। তারপর পাড়াতে এর ওর বাড়ি গিয়ে বসে বসে ২/৪টে গান গাইতাম। কেউ এক কাপ চা দিত, আবার কেউ দু’-একটি বিস্কুটও সঙ্গে দিত। সকলে গান শুনে উৎসাহ যোগাত এবং সহযোগিতাও করত। আবার কেউ কেউ হিংসেও করত। কেউ পেছনে কিছু বললে দাদুকে এসে বলতাম। উনি বলতেন, ‘যারা হিংসে করবে তারা পিছনে পড়ে থাকবে। তুই অনেকদূর এগিয়ে যাবি, তোকে কেউ রুখতে পারবে না।’
দাদুর মুখে এই আশীর্বাদ শুনে মনে সবসময়ই আনন্দের স্রোতধারা বইত। এইভাবে গানের রেওয়াজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গান গাইতে বসতাম আর প্রতিটি গান গেয়ে তার অর্থ জেনে নিতাম। একদিন পাশের গ্রামে হিন্দু পল্লিতে গেলাম গান গাইতে। অন্যদেশ থেকে এসেছেন একজন বাউল শিল্পী। তাঁর সঙ্গে পাল্লাগান গাইতে কেউ বলছে, ‘যতীন তোমার ভাল হচ্ছে, কিন্তু ওঁর গানের পাশে উত্তর হচ্ছে না।’
আমি খুবই চেষ্টা করে অল্প শেখা বিদ্যা নিয়ে লড়াই করলাম তবে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব আমার জানা নাই। অন্ধকার বোধ করলাম। মনে মনে ছটফট করতে করতে একটি গানের অর্থই বুঝলাম না, তার উত্তর দেব কী! প্রশ্ন-গান/ ‘না-পাকে পাক হয় কেমনে। জন্ম বীজ যার না-পাক কয় মৌলবী গণে’—। বাড়ি এসে ওই কথাগুলি দাদুকে বললাম। উনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘প্রশ্ন খুব চমৎকার করেছে, তবে এর জবাব আমি বলি তুই শোন্— থালাতে ভাত হাতে তুলে মুখে দিয়ে খায়। কিন্তু খাওয়ার পর হাত মুখ থালা ধুতে হয় কারণ এগুলো এঁটো হয়ে গেছে, ভাত পবিত্র জিনিস—তাই ওতে কোনও না-পাক জিনিস নেই। তবে বাউল গান শিখতে হলে বাউল গোঁসাই ধরে শিক্ষামন্ত্র নিতে হয়। তোকে আমার এক বন্ধুর কাছে যেতে হবে যার বাড়ি নওপুকুরিয়া গ্রামে। আমি ওকে তোর জন্যে বলছি, বৈষ্ণব তত্ত্ব আমার জানা নেই। শিক্ষাগুরু বাদে যে-কাজ চোদ্দো বছর লাগে আর গুরু ধরে ওই কাজ করলে চোদ্দো দিনের মধ্যে কর্মশিক্ষা হয়ে যায়।’ দাদুর মুখে এই সমস্ত কথা শুনে মনে এক নতুন আগ্রহ বেড়ে গেল।
এক সন্ধ্যায় নওপুকুরিয়ার গোঁসাই মদনদাস বৈরাগ্যের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। পাতলা ছিপছিপে লম্বা একজন মানুষ। মাথায় পাকা চুল বড় বড়, সামনে ঝুঁটি বাঁধা, মুখে দাড়িগোঁফে ভরতি। বগলে একটি সিদ্ধের ঝোলা, কয়েকজন ভক্ত নিয়ে গাঁজা খাচ্ছে। গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই বললেন, ‘নিশ্চয়ই তোর নাম যতীন হাজরা? আয় বোস।’ মাটির একটি চারচালাঘর, চারদিকে বারান্দা নামানো। পাশে বসতেই বললেন, ‘তোকে জাফর পাঠিয়েছে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। আবার বললেন, ‘বল, তুই কী জানতে চাস?’ আমি বললাম, ‘আমি একজন বাউলগানের শিল্পী হতে চাই। শিল্পী হতে গেলে যে সমস্ত তত্ত্ব জানা বা শেখার দরকার তা আপনাকে সব দিতে হবে।’ উনি বললেন, ‘বিয়ে করেছ?’ ‘হ্যাঁ, তবে সে বউ নেই, মারা গেছে।’ ‘তোর শিক্ষা তো হবে না’—উনি বললেন, আরও বললেন, ‘বাউল তত্ত্ব শিখতে গেলে স্বামী স্ত্রী যুগলে মন্ত্র নিয়ে হাতে-কলমে কর্ম সাধতে হবে, কারণ আশ্রয়বিহীন সাধনা সম্ভব নয়, নিজ আশ্রয়ে রসের আলাপন, রসের কর্ম নীরসে হয় না, স্বামী-স্ত্রী যুগলে রসের কর্ম করে বাউল জগতকে জানতে হয়।’