গানের জীবিকা ছাড়াও জালাল ফকির কিছু টোটকা চিকিৎসা করেন। বিশুদ্ধ ফকির তাঁকে বলা যায় না। সংসারী মানুষের মতো তাঁর আত্মোপলব্ধি।
জালাল শাহ-র কথা—৪
বাস্তুভিটা ছাড়া আমার কোনও জমি-জায়গা নাই। বাবার স্থান থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা পাই তা থেকে সংসার চলে। এ ছাড়া গান-বাজনা করি, তাগা-তাবিজ করি— এ থেকেও কিছু চলে আসে। এইভাবে মোটামুটি কোনওরকমভাবে চলে। এ ছাড়া আর কোনও রোজগার নাই কিন্তু আমি ফকিরই থাকতে চাই— অন্য কিছু করার কথা কখনও মনে আসে না। সরকারের সাহায্য কখনও পাইনি। বাবা থাকতে আগে সরকারি অনুষ্ঠানে গান করতে গেছি। এখন যাওয়া হয় না বাইরে। এরকম ডাক অনেকদিন আসেনি। সরকারি সাহায্য কখনও চাইনি, আশা করিনি।
আমার জীবনে প্রথম শেখা গান—‘বন্ধুর বাড়ি হতে রে মন/আইছি অনেকদিন গো আমি’ দায়েম শাহ ফকিরের লেখা। এই গানটা সবসময় গাইতে ইচ্ছা করে। আমার নিজের গানও আছে দু’-একটা।
আমার মন্তব্য
জালাল শাহ একেবারে রিক্ত ফকির। ফকিরডাঙার দায়েম শা-র যে আস্তানা ছিল তার দাতা সম্ভবত তাঁর মুর্শেদ আলমবাবা। সেই আস্তানাই জালাল-কথিত বাস্তুভিটা। আলম বাবা আর দায়েম শা-র সমাধি মুখোমুখি আছে ফকিরডাঙায়। ভারী শান্ত ও নিস্তব্ধ স্থান, দেখলে মনে ভক্তিভাব জাগে। জায়গাটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের খানিকটা শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম আছে, তাই অনেকে মানসিক করে, টাকাপয়সা দেয়। এ ছাড়া এই আশ্রমের গা বেয়ে, আক্ষরিক অর্থে ছুঁয়ে, দিনেরাতে ক’জোড়া অন্ডাল-সাঁইথিয়া ট্রেন চলে। তার যাত্রীরা টাকাপয়সা ছুড়ে দেয় জানলা দরজা দিয়ে। ফকির বাড়ির মেয়েরা ট্রেন চলে গেলেই ‘কুড়িয়ে বাড়িয়ে’ সেগুলো জড়ো করে। তাই দিয়ে চলে ফকিরের সংসার। এর বাইরে গানবাজনা করে আর তাগা-তাবিজ দিয়ে ক’ পয়সা আর হয়?
‘কিন্তু আমি ফকিরই থাকতে চাই’—এরপরও এমন ঘোষণা বোঝায় যে, জালাল অন্তরে বাইরে ঘোরতর ফকির। কেউ কেউ কি বলবেন, পলায়নবাদী? না, এদের সম্পর্কে সরকারি বদান্যতা আশা করা যায় না। পরিচিতি নেই, প্রচার নেই—সরকার জানবেই বা কী করে? সরকারি ডাক আসেনি বহুদিন, জালাল আশাও করেন না, উদ্যমও নেই। গোলাম শা-র মতো জালাল নানা জায়গায় প্রোগ্রাম করেন না তাই লোকে তাঁকে চেনে কম। তবে জালাল একদিক থেকে এগিয়ে আছেন—তিনি নিজে গান লিখে সেই গানে সুর বসিয়ে গাইতে পারেন। তাঁর গান ও গায়ন সংরক্ষিত হলে ভাল হয়।
জালাল শাহ-র কথা—৫
ফকিরি সাধনার রাস্তায় ভেতর বা বাইরে থেকে বা নিজের মন থেকেও কখনও কোনও বাধা পাইনি। বাধা দেবার মতো তেমন কেউ কেউ আছে— কিন্তু আমি তেমন কাউকে দেখিনি, বা আমার কাছে এসে দাঁড়াতে পারে না।
শুয়োরকে মৌলানা মৌলবিরা হারাম বলবে— আমরা হারাম বলব না। আমি খাই না; ঠিক আছে, কিন্তু হারাম বলাটা ঠিক নয়। শুয়োরকেও সেই তো সৃষ্টি করেছে, তাকে ঘৃণা করা ঠিক নয়।
আমরা গান-বাজনা করি। কেউ হয়তো ডেকে নিয়ে গেল, বলল— কালীমন্দিরে গান করতে হবে। তা হলে করতে হবে। এইবারে আল্লা-হরি দুটিকেই মিশিয়ে বলতে হবে। ফকির-মস্তান হচ্ছে—সর্ববিরাজী। সব জায়গায় যেতে পারে, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে। কিন্তু মৌলবিরা সেখানে যাবে না।
আমার মন্তব্য
জালাল শাহ তাঁর ফকিরি সাধনায় ভেতরে বাইরে কোনও বাধা পাননি, কারণ তাঁরা বংশগতভাবে ফকির। নিজের মধ্যে বাধা পাননি কারণ জন্মেই তো আলম বাবা আর দায়েম শা-র মাজারের ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছেন। তেমন বিদ্যালাভ ঘটেনি, জমিজমা নেই— কণ্ঠে সুর ছিল, পিতার কাছে একটু-আধটু শিখে চালিয়ে যাচ্ছেন। খুব বড় মাপের পারফরমার নন গোলাম শা-র মতো। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ কে করতে যাবে? কেনই বা? তা ছাড়া দুবরাজপুর প্রধানত হিন্দু জনবসতির স্থান। একজন দু’জন ফকির সেখানে সমাজস্রোতের অংশ। দেখাই যাচ্ছে, কালীমন্দিরে গান করার আহ্বান তাঁর কাছে এসেছে বা আসে।
আসলে জালাল শা-র মনের মধ্যে অনাবিল ঔদার্য রয়েছে, যেটা আবহমান কালের ফকিরি ধারা। আল্লা আর হরিকে মেলাতে তাঁর অসুবিধা হয় না। আল্লাকে মহান স্রষ্টা বলে মানেন বলে, মানুষ আর শুয়োরকে হালাল হারাম ভেদ করেন না। সবচেয়ে সার কথা, যেটা তাঁর মনে হয়েছে, ফকিররা সর্ববিরাজী। তাঁদের চলমানতা এক মহৎ গুণ এবং সব কিছু গ্রহণ করার আগ্রহ। মোল্লা মৌলবিরা অনেকটা বদ্ধ জীব— শাস্ত্ৰবন্ধনে, মসজিদ এবং শরিয়তি আচার মার্গে।
জালাল শাহর কথা—৬
ফকির আর বাউল বেশি দূরের নয়। গান-বাজনা ও কিছু মনোভাব নিয়ে বাউল ফকির কাছাকাছি আসে। কৃষ্ণতত্ত্ব ও মুর্শিদতত্ত্ব—মূল একটাই। তারপর এটাকে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। সাধু-সন্তদের মতো সাধনায় ফকিরদেরও বাহ্যজ্ঞানশূন্য দশা হয়।
গান গাওয়ার সময় সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো পরি, সাদা পাঞ্জাবি পরি, গলায় একটা গামছা থাকে। সেটা রঙিন হতে পারে, আবার সাদাও হতে পারে। মাথায় হয়তো একটা পাড় বেঁধে নিলাম। গায়ে আলখাল্লাও পরে নিতে পারি।
গানের সঙ্গে বেহালা, ডুবকি, দোতারা, গাবগুবি, করতাল, চিমটে ব্যবহার করি। আরও কিছু যন্ত্র হলে ভাল হয়, যেমন—ঢোল, হারমোনিয়াম।
চুল রাখাটা আমাদের ধর্ম। হাতে যে লাঠি (‘আসা’) থাকে, সেটা হল হাতের সম্বল। যখন যেখানে গেলাম, বসলাম—হাতে একটা আসা থাকল। ফকিরদের ব্যবহৃত জিনিসের মধ্যে কিস্তি, লোটাকম্বল, ঝোলা, ‘আসা’ সবই থাকবে।
আমার মন্তব্য
জালাল শাহ ফকির হলেও কোনওভাবে তাত্ত্বিক নন। বেশির ভাগই শোনা কথা বলেন। আজহার খাঁ কিংবা আবু তাহেরের মতো তাত্ত্বিক ও চিন্তাশীল ফকিরদের সঙ্গ করেছি বলে এটা বুঝতে পারি। শাস্ত্র ও শরিয়তের বিরুদ্ধতা করতে গেলে পঠন পাঠন দরকার। তার জন্য ঘরগৃহস্থী দরকার। চাই শান্ত আত্মমগ্ন অবকাশ। চাই আরও দু’-একজন তাত্ত্বিক ও বিরুদ্ধপক্ষ। ব্যক্তিজীবনে আবু তাহের ও আজহার খাঁকে বহুবার আলেম বা মোল্লাদের সঙ্গে ‘বাহাস’ করে মোকাবিলা করতে হয়েছে। জালাল শাহ এঁদের তুলনায় অনেক অনুজ ও অর্বাচীন। তাই কৃষ্ণতত্ত্ব ও মুর্শিদতত্ত্ব মূলে এক এ ধরনের মন্তব্য জেনে বুঝে করা নয়, মুখের কথা। বেশ শুনতে লাগে। ফকির ও বাউল বেশিদূরের নয় হয়তো, কিন্তু কারণটা অন্তত জালাল শাহ বর্গের ফকিরদের অধিগম্য হওয়ার কথা নয়।